আমার জন্মস্থান বরিশাল। বাবার বাড়ি বৃহত্তর সিলেটের বর্তমান মৌলভীবাজার জেলায়। বাবা তরণী কান্ত দেব।বাবার সরকারি চাকরির সুত্রে ৫০-এর দশকে বদলী হন বরিশাল জেলায়। আমরা চার বোন, তিন ভাই।আমার বড়ো দুই বোন, তিন ভাই। আমার ছোট এক বোন মিনি। মায়ের প্রথম দুই সন্তান (১ ছেলে ও ১ মেয়ে) ৬ মাসের আয়ু নিয়ে এসেছিল। মেজো বোনের পরে যে ছেলে সন্তান সেও বেশী দিন বাঁচেনি। মা বলতেন, ঐ ভাইএর মতো সুন্দর নাকি আমরা কেউ জন্মাইনি। আমিও নাকি ৬ দিন বয়সে ডাইরিয়া হয়ে মরেই যাচ্ছিলাম। মা সবসময় বলতেন, মোজাম্মেল ডাক্তারের চিকিৎসায় বেঁচে গেছিলাম সেই যাত্রায়। আমার তখনো এক মাস বয়স হয়নি, মেজবোনকে দরজায় বসিয়ে রেখে মা স্নান করতে গেছেন। অসুয ঘর কিনা, তাই কারো সেই ঘরে ঢোকা বারণ ছিলো। মেজদি সুযোগ পেয়ে ঘরে ঢুকে গেল আমাকে কোলে তুলবে বলে। কোলে নিতেই আর সামলাতে পারলো না! ওর ই বা কি বয়স, আট/নয় বছর মাত্র। পড়ে গিয়ে নিশ্চয়ই অনেক ব্যাথা পেয়েছিলাম। আমার কান্নার ভয়ংকর শব্দ শুনতেই মা দৌড়ে এলেন।মেজদি ততক্ষণে মায়ের হাতের নাগালের বাইরে। সেই মোজাম্মেল ডাক্তার এলেন। হাত পা নেড়েচেড়ে দেখলেন। বুঝতে চাইলেন কি হয়েছিল। মেজবোনকে জিজ্ঞাসাবাদে বের হলো আসল কথা। বেচারা! যাক, সেই যাত্রায়ও বেঁচে গেলাম! আমার জন্ম শ্রাবণ মাসে, আশ্বিনে দূর্গাপূজা। বাসার কাছে কাঠপট্টি প্রতিমা দেখে এসে প্রতিবেশিরা মাকে বলতেন, প্রতিমার মুখখানা তো পুরাই আপনার মেয়ের মুখ!মেজদির মুখে শুনেছি সেই কথা। একবার কথা প্রসঙ্গে অনিলবাবুকে বলেছিলাম আমার ঠিকুজির নাম 'প' দিয়ে রাখার কথা--অনিলবাবু বলে উঠলেন, হুম 'প্রতিমা' হতে পারতো। কি আশ্চর্য, ঠিকুজি বের করে দেখি আমার নাম লেখা - প্রতিমা। তারও অনেক বছর পর, রেডিওতে সংবাদ পাঠকদের এক অনুষ্ঠানে, একজন জিজ্ঞেস করে বসলেন, আপনার মা বুঝি আপনাকে গর্ভে নিয়ে শুধু প্রতিমার মুখ দেখতেন! আপনার মুখখানা দেখতে একদম প্রতিমার মতো, আঁকা-আঁকা! আমি হেসে ফেললাম! শুনতে ভালো লাগলেও, বরাবরই এরকম প্রশংসা আমাকে অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। প্রতিমার রূপ, সেতো অন্তরের সৌন্দর্যের প্রতিক। ঈশ্বরের দেয়া মুখশ্রী, তার সাথে যে মন ও মনন, সেই সৌন্দর্যের চর্চা আজীবন করে যেতে হয়। সেই রূপটাই যথার্থ, ক্রমশ বিকাশমান, অক্ষয়। রূপের কথা থাক। স্বভাবে আমি শান্ত, নরম, আর শারীরিকভাবে বরাবরই দুর্বল। খেলার মাঠে খেলতে গেলাম, সেখানে পড়ে গিয়ে অজ্ঞান। ছোটবোন মিনি, ওর জ্বর, ও খেলতে যেতে পারবেনা তাই আমাকেও যেতে দিবে না। মা'কে বলে লুকিয়ে যাবার বেলায় হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়ে হাতে প্রচন্ড ব্যথা পেলাম, তাও আবার ডান হাত। ভাঙেনি কিন্তু মা কয়দিন বাদে খেয়াল করলেন যে ডান হাত চিকন হয়ে যাচ্ছে। হোমিওপ্যাথি ডাক্তার নিশিকান্তবাবু, ওনার ওষুধে ভালো হলাম। বরিশালের বাড়িগুলোতে বাসার সামনে বসার একরকম জায়গা থাকতো,রোয়াক বলতো।একবার সেখানে বসতে গেলে মিনি আমাকে ধাক্কা দিল, আর আমি পড়ে গিয়ে ঠোঁট কেটে রক্তাক্ত! সিস্টারডে প্রাইমারী স্কুলে পড়তাম। দুইবোন একসাথে স্কুলে যাচ্ছি, পথে ছাগল বাঁধা দড়ি টপকাতে যেয়ে আমি হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলাম। মিনি দিব্যি স্কুলে চলে গেলো, আর আমি কাঁদতে কাঁদতে বাসায় মায়ের কাছে চলে এলাম। বেশী নয় অল্প স্বল্প ব্যাথা। মা বললেন, স্কুলের কাছাকাছি পড়ে ব্যাথা পেলি, তো স্কুলে না যেয়ে এতোটা পথ ব্যাথা নিয়ে হেঁটে আসলি কেন? সেদিন মাকে বোঝাতে পারিনি ব্যাথা পেয়ে যে আমি মা'কেই কাছে পেতে চেয়েছিলাম। মায়ের হাঁপানি রোগ ছিল। অনেক কষ্ট পেতেন। আমার মায়ের জন্যে খুব মন খারাপ থাকতো। রাতে মায়ের পাশে মিনি, তার পাশে আমি ঘুমাতাম। অনেক সময় মায়ের সাড়াশব্দ না পেলে মনে হতো মা বুঝি আর বেঁচে নেই, অমনি কান্না চলে আসত। যেই মা বলতেন কি হয়েছে, কাঁদিস কেনো? -- আহা কি শান্তি!!