হজরত আলী রাজিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ওয়া কারামাল্লাহু ওয়াজহাহু। একটি জীবন। একটি ইতিহাস! বরঞ্চ অনেক ইতিহাসের সমন্বয়! ইসলামি জাহানের এই মহান পুরুষের নাম দুনিয়ার প্রতিটি মুসলমানের নিকট অতি সুপরিচিত। কিন্তু তার সম্পর্কে নিবিড়ভাবে জানে কয়জন? এই খেয়াল থেকেই পবিত্র এই জীবনীটি বইয়ের পাতায় লিপিবদ্ধ করার বাসনা জাগে। শুরুতেই কিছু কথা পরিষ্কার করে দেওয়া দরকার মনে করি। প্রথমত আমি ইতিহাসবিদ নই। ইতিহাস আমার প্রিয় পাঠ। ইতিহাস পড়তে পড়তে মহান খলিফা হজরত আলী (রা.) সম্পর্কে যতটুকু জেনেছি, আর দশজনকে তা জানাতে একটা তাড়না বোধ করছি। জানি না কেন, হয়তো হজরত আলী (রা.) কে খুব বেশি ভালোবাসি বলেই! দ্বিতীয়ত, এই জীবনীটি লেখা হয়েছে, একজন মুগ্ধ আশেকের দৃষ্টিকোণ থেকে; প্রাণহীন, নিরেট ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে নয়। তবে একথা নিশ্চয়তা দিয়ে বলা যায় যে, এই বইতে সত্যের কোনো বিকৃতি ঘটানো হয়নি, অন্তত জ্ঞাতসারে। ইতিহাসের দুটো অঙ্গ: প্রথমটি হলো ঘটনার বর্ণনা আর দ্বিতীয়টি হলো ঘটনার ব্যাখ্যা। পৃথিবীতে যা যা ঘটে গেছে তা ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এটাই ইতিহাসের মূল উপজীব্য। এই অংশটুকু পালটানো বা ফেরানো যায় না। বেশি থেকে বেশি যা করা যায়, তাহলো ঘটনার বর্ণনায় বিকৃতি সাধন কিংবা ঘটনাকে ধামাচাপা দেওয়া। কিন্তু সত্য তো অপরিবর্তনীয়! সময় নামক খনিতে তা গেঁথে আছে! হিম্মত থাকলে তাকে টেনে তোলা যায়। গ্রন্থকার সেই হিম্মতটুকুই করেছেন। তাই শতভাগ চেষ্টা ছিল নিরেট সত্যটুকু যেন অমলিনভাবে প্রকাশিত হয়। আর এই তাকাজার পেছনে ছিল সর্বজ্ঞানী-সর্বদ্রষ্টা মহান আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি অর্জনের আকাঙ্ক্ষা। এবারে আসি ইতিহাসের দ্বিতীয় অঙ্গ অর্থাৎ ঘটনার ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে। পাঠক সমাজের সামনে প্রথমেই আমরা পরিষ্কারভাবে আমাদের বক্তব্য তুলে ধরতে চাই যে, এখানে আমরা হজরত আলী (রা.) এর গুণমুগ্ধ ভক্ত। আমাদের দৃষ্টিতে তিনি সমালোচনার ঊর্ধ্বে। আমরা তাঁর প্রতিটি কাজ এবং পদক্ষেপকে সঠিক মনে করি। তাই চেষ্টা করেছি, সেগুলোর যথার্থতা প্রমাণ করার। আমাদের যুক্তি যদি গ্রহণযোগ্য হয়, তবে সব প্রশংসা মহান আল্লাহ পাকের। আর যদি বাতিল মনে হয়, সেটা আমাদের ব্যর্থতা। কিন্তু হজরত আলী (রা.) সঠিক পথেই ছিলেন, এটাই আমাদের বিশ্বাস। হজরত আলী (রা.) এর জীবনী নিয়ে লেখা অনেক ইতিহাসগ্রন্থ বাজারে বিদ্যমান। তবে এই অধম, অযোগ্য লেখকের কেন এই দুঃসাহসিক প্রচেষ্টা? আসলে মহব্বত মানুষকে অন্ধ করে দেয়। তখন সে ভুলে যায়, পাহাড় থেকে লাফ দিলো নাকি সাগরে ঝাঁপ দিলো। এই বইটিও তেমনি এক মহব্বতের বহিঃপ্রকাশ। যদি প্রশ্ন করা হয়, জগতের সবচেয়ে মজলুম ব্যক্তিটি কে? তবে এই প্রশ্নের জবাব দেওয়া প্রায় অসম্ভব। কিন্তু যদি প্রশ্নটি একটু বদলে দেওয়া হয়, ইতিহাসের সবচেয়ে মজলুম শাসনকর্তা কে? তাহলে উত্তর বের করতে খুব একটা বেগ পেতে হবে না। এক্ষেত্রে হজরত আলী (রা.) এর নামটি সবার আগে আসার সম্ভাবনা অনেক বেশি। এই মহান ব্যক্তিটি ক্ষমতায় যাওয়ার পর থেকে আমৃত্যু একটি দিন কিংবা রাত পার করতে পারেননি, যেটি ছিল সমস্যামুক্ত। তবে এই সমস্যা তাঁর ব্যক্তিগত সমস্যা ছিল না, উহা ছিল গোটা মুসলিম উম্মাহর সমস্যা। কিন্তু বিনিময়ে উম্মাহ তাকে যা প্রাপ্য তা দেয়নি। হায়াতকালে ঘনিষ্ঠদের আচরণে তিনি বারংবার ক্ষত-বিক্ষত হয়েছেন। আর মৃত্যুর পরে শত্রু কর্তৃক মিথ্যা সমালোচিত হয়েছেন। কিন্তু শত্রু-মিত্র কেহই বিগত ১৪০০ বৎসরে, একবারও বলেনি যে, তিনি উম্মাহর তুলনায় নিজেকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। নবুয়তি চরিত্রের এই বৈশিষ্ট্যটুকু তিনি শতভাগ সার্থকতার সাথে অনুসরণ করেছিলেন। আর এর পুরস্কার তিনি পেয়েছিলেন সরাসরি মহান আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে, এভাবে যে, তিনি ছিলেন আশারা-মুবাশশারার (অর্থাৎ দুনিয়াতে জীবিত থাকা অবস্থায় জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত ১০ জন বিশিষ্ট সাহাবির মধ্যে একজন) একজন। (তিরমিযি: ৩৭৪৭)