সাত বছর বধূজীবন যাপন করিবার পর বাইশ বছর বয়সে শীতলের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী শ্যামা প্রথমবার মা হইল। এতকাল অনুর্বরা থাকিয়া সন্তান লাভের আশা সে একরকম ছাড়িয়াই দিয়াছিল। ব্যর্থ আশাকে মানুষ আর কতকাল পোষণ করিতে পারে। সাত বছর বন্ধ্যা হইয়া থাকা প্রায় বন্ধ্যাত্বের প্রমাণেরই শামিল। শ্যামাও তাই জানিয়া রাখিয়াছিল। সে তার মায়ের একমাত্র সন্তান। একমাত্র সন্তান না হইয়া তার উপায় অবশ্য ছিল না, কারণ সে মাতৃগর্ভে থাকিতেই তার বাবা ব্রহ্মপুত্রে নৌকাডুবি হইয়া মারা যায়। তারপর তার আর ভাইবোন হইলে সে বড় কলঙ্কের কথা হইত। শ্যামার যেন তাহা খেয়াল থাকে না। সে যেন ভুলিয়া যায় যে, তার বাবা বাঁচিয়া থাকিলে সাতভাই চম্পার একবোন পারুলই হয়তো সে হইত, বোনও যে তাহার দু-পাঁচটি থাকিত না, তাই বা কে বলিতে পারে? তবু, একটা যুক্তিহীন ছেলেমানুষি ধারণা সে করিয়া রাখিয়াছিল যে, সে নিজে যখন এখন এক মার এক মেয়ে, দুটি একটির বেশি ছেলেমেয়ে তারও হইবে না। বড় জোর তিনটি। গোড়ার কয়েক বছরের মধ্যেই এরা আসিয়া পড়িবে, এই ছিল শ্যামার বিশ্বাস। তৃতীয় বছরেও মাতৃত্বলাভ না করিয়া সে তাই ভীত হইয়া উঠিয়াছিল। তার পরের চারটা বছর সে পূজা, মানত, জলপড়া, কবচ প্রভৃতি দৈব উপায়ে নিজেকে উর্বরা করিয়া তুলিতেই একরকম ব্যয় করিয়াছে। শেষে, সময়মতো মা না হওয়ার জন্য এবং দৈব উপায়ে মা হইবার চেষ্টা করিবার জন্য নানাবিধ মানসিক বিপর্যয়ের পর তার যখন প্রায় হিষ্টিরিয়া জন্মিয়া যাওয়ার উপক্রম হইয়াছে, তখন ফাল্গুনের এক দুপুরবেলা ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করিয়া শীতলপাটিতে গা ঢালিয়া ঘুমের আয়োজন করিবার সময় সহসা বিনাভূমিকায় আকাশ হইতে নামিয়া আসিল মন্ত্রের।
শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম, মধ্যবিত্ত সমাজের কৃত্রিমতা, নিয়তিবাদ ইত্যাদি বিষয়কে লেখার মধ্যে তুলে এনে বাংলা সাহিত্যে যিনি অমর হয়েছেন, তিনি হলেন প্রখ্যাত ভারতীয় বাঙালি কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। খ্যাতিমান এই সাহিত্যিক ১৯০৮ সালের ১৯ মে বিহারের সাঁওতাল পরগনায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রকৃত নাম প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, আর মানিক ছিলো তাঁর ডাকনাম। বাবার বদলির চাকরিসূত্রে তাঁর শৈশব, কৈশোর ও ছাত্রজীবন কেটেছে বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে, যার ফলে বিভিন্ন অঞ্চলের পটভূমিতে বিভিন্ন সাহিত্য রচনা করেছেন তিনি। প্রবেশিকা ও আইএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় গণিত বিষয়ে অনার্স করতে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। এখানে পড়াশোনাকালে বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে তিনি 'অতসী মামী' গল্পটি লেখেন। সেই গল্পটি বিখ্যাত 'বিচিত্রা' পত্রিকায় ছাপানো হলে তা পাঠকনন্দিত হয় এবং তিনি সাহিত্যাঙ্গনে পরিচিত হয়ে ওঠেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি সাহিত্য রচনায় পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন, যার ফলে তাঁর পড়াশোনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এবং তিনি আর পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি। তাঁর হাতে বাংলা সাহিত্যে এক বৈপ্লবিক ধারা সূচিত হয় ঐ সময়ে, যখন সারা পৃথিবী জুড়ে মানবিক বিপর্যয়ের এক চরম সংকটময় মুহূর্ত চলছে। কমিউনিজমের দিকে ঝুঁকে যাওয়ায় তাঁর লেখায় একসময় এর ছাপ পড়ে এবং মার্ক্সীয় শ্রেণীসংগ্রাম তত্ত্ব দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমগ্র। ফ্রয়েডীয় মনোসমীক্ষণেরও প্রভাব লক্ষ্য করা যায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র-তে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমূহ এর মধ্যে 'পদ্মানদীর মাঝি', 'দিবারাত্রির কাব্য', 'পুতুলনাচের ইতিকথা', 'শহরতলি', 'চতুষ্কোণ', 'শহরবাসের ইতিকথা' ইত্যাদি বিখ্যাত উপন্যাস, এবং 'আত্মহত্যার অধিকার', 'হারানের নাতজামাই', 'বৌ', 'প্রাগৈতিহাসিক', 'সমুদ্রের স্বাদ', 'আজ কাল পরশুর গল্প' ইত্যাদি গল্পগ্রন্থ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা রচনার কিছু নিদর্শন থাকলেও সেগুলো তেমন উল্লেখযোগ্যতা অর্জন করেনি। অসামান্য এই কথাসাহিত্যিক মাত্র ৪৮ বছর বয়সে ১৯৫৬ সালের ৩ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।