কতজন কুরআনকে বোঝার ও তার স্পর্শে আসার, কুরআন কেন্দ্রিক জীবনযাপন করার বই লিখছেন। ও সামনে কুরআনের মাসকে কেন্দ্র করে রামযানি জীবন-যাপনের সবরকম ব্যবস্থা নিচ্ছেন, মাশাআল্লাহ্ এটি অন্তত সুখের বিষয়। কুরআনের রয়েছে অনেক আবেদন-নিবেদন। বিভিন্ন পর্যায়ের দাবী-দাওয়াহ্। তার সকল আবেদনের মাঝে সবচে‘ বেশি গুরুত্বপূর্ণ দাবী হলো তা শুদ্ধভাবে পাঠ করা। আর তা তাজভীদের মাধ্যমেই সম্ভব। এতেই কুরআনের প্রাথমিক আবেদন পূরণ হয়। এরপর থাকে আদেশ-নিষেধ পালন ও তার প্রচার-প্রসার। এদিকে ইঙ্গিত করেই তামীম দারী রাযি. বর্ণনা করছেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে… আল্লাহর রাসূল বলেন, দ্বীন মূলতই নাসিহাহ্ বা কল্যাণকামনা। সাহাবা কিরাম বললেন: কার জন্য নাসিহাহ্-কল্যানকামনা ?? উত্তরে তিনি বললেন, এ কল্যাণকামনা হবে আল্লাহ্ ‘আযযা ওয়া জাল্লাহ্ এর প্রতি, এরপর তার কিতাব ও তার রাসূলের প্রতি, মুসলমানদের শাসকগোষ্ঠির প্রতি; তাদের সকলের প্রতিই নাসিহাহ্-কল্যাণকামনা করা। সহীহ মুসলিম। . ❒ আচ্ছা কখনও ভেবে দেখেছেন? আমরা যার রিওয়ায়াত অনুযায়ী কুরআন পাঠ করে আসছি, তিনি কে, তার ব্যক্তি-পরিচয় কী, তাজভীদ শাস্ত্রে তার অবদান, এ শাস্ত্রে কাদের অগ্রণী ভূমিকা ছিলো ?? সর্বাপরি হাদিসের মত কুরআনের বর্ণানায়ও রয়েছে সিলসিলা, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পর্যান্ত রিওয়ায়াত-সূত্র ! তাকি আমরা জানি? হাদিসের ক্ষেত্রে সালাফগণ যেমন রিওয়ায়াতের ধারাবাহিকতার গুরুত্ব দিতেন তেমনি গুরুত্ব দিতেন কুরআনের ব্যাপারেও। বর্তমানে আমরা যে তিলাওয়াত করি তার সূত্রটি হলো- ‘‘ ইমাম হাফস তার শিক্ষক ‘আসিম থেকে তিনি আবু আব্দুর রহমান আস সুলামি থেকে, তিনি আলি বিন আবি তালিব রাযি, থেকে আর তিনি স্বয়ং আল্লাহ্ র রাসূল থেকে কুরআন বর্ণনা করেন। আর রাসূল জিবরিল আমিন থেকে আর তিনি বর্ণনা করেন সরাসরি আল্লাহ তায়ালা থেকে।’’ ❒ সারা পৃথিবীতে ইমাম হাফস রাহিমহুল্লাহ্ এর পাঠ-পদ্ধতি সুপ্রসিদ্ধ ও অনুসরণীয়। আরব-আজমের বেশির ভাগ তাকেই অনুসরণ করে। এছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন পদ্ধতির তিলাওয়াত। সেগুলোকে সাত ক্বিরাআত বা দশ ক্বিরাআত বলে। ইউটিউবে ‘তিলাওয়াত’ লিখে সার্স দিলে পুরাতন ক্বারি আব্দুল বাসেত থেকে শুরু করে বর্তমানের আব্দুর রহমান সুদাইস, মিশারি আফফাসী, মাহির মু‘আইক্বিলি, শুরাইম হাফিযাহুমুল্লাহ্, দেখা যায় তাদের সকলের তিলাওয়াত ইমাম হাফসের রিওয়ায়াতেই। এটি মূলত: উসমানি খিলাফাত আমলে ইমাম হাফস রাহি. এর ক্বিরাআত রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে। সে সুবাদে বর্তমান পৃথিবীর সিংহভাগ তিলাওয়াত করছেন তার পদ্ধতির নকলে। মরোক্বের লোকেরা তিলাওয়াত করেন ইমাম নাফির রিওয়াতে; কখনও ওরশের ধারায় কখনও অপর ছাত্র ক্বালুনের ধারায়। আর সুদানবাসীদের তিলাওয়াত হয় আবু আমর আদ্দুরির ধাঁচে। তাদের কুরআন সাধক ‘‘আব্দুর রশিদ সূফি’’ হাফি. এর তিলাওয়াত তো এখন বেশ জনপ্রিয় । এই হলো সারা পৃথিবীর তিলাওয়াত-বৈচিত্রের সংক্ষিপ্ত চিত্র। কিন্তু তাদের অধিকাংশ আরব হওয়ায় তাদের তিলাওয়াত-চর্চা পাঠ ও পঠন পদ্ধতির পতিপালন হয় সরাসরি আরবী বা মূল সোর্স থেকে। এতে তাদের হাফস্ এর রিওয়ায়াত পড়লেও যেমন বিশুদ্ধতার জন্য নির্ভরযোগ্য বইয়ের নিয়ম-নীতিকে ফলো করতে সুবিদা হয় ; সময় সুযোগে একটু অন্য রিওয়াতেও পড়ার চেষ্টা করা যায়। কায়দাগতভাবে মিস গাইড আশংকা থাকে খুব কম। কারণ তাদের গাইডবুক খুবই তথ্যসমৃদ্ধ ও জ্ঞানমূলক। কিন্তু আমাদের বাঙাদেশের প্রেক্ষাপট একটু ভিন্ন। এখানে চর্চা হয় শুধুমাত্র ইমাম হাফসের রিওয়ায়াত। হালাকায়, মসজিদ মাদারাসায় সম্পূর্ণ উস্তাদের তদারকিতে । পড়ার নিয়মকানুনের পাঠ্যবই হলো নুযহাতুল কারী, জামালুল কুরআন ইত্যাদি বইগুলি। এখানে বইয়ের জ্ঞানের তুলনায় উস্তাদের সরাসরি মশক্বেই বেশী গুরুত্ব দেওয়া হয় । বাঙালির এসব চটি বই-ই ছিলো কুরআন বিশুদ্ধকরণের মাপকাঠি বা সহায়কগ্রন্থ। অন্যান্য ক্বিরাআতের কথা বাদ থাক, শুধু ইমাম হাফস্ এর রিওয়াতের তাজভীদের অনেকাংশই আমাদের অজানা রয়ে গেছে। যেমন, • মাদ্দে মুনফাসিলকে খাটো করে পড়ার ক্ষেত্রে আরবী কিতাবগুলোতে যে আঠারোটিরও বেশী নিয়ম আছে ও মক্কা-মাদীনার ইমামগণ যেগুলোকে খুব গুরুত্ব দিয়ে পড়েন, আমাদের বইগুলোতে সেগুলোর বিবরণ অনুপস্থিত। • ওয়াকফের ক্ষেত্রে সুকুন, রওম, ইশমাম ও ইখতিলাস কি? • হায়ে যামীর ও হায়ে কিনায়াহ্ কি? • আমরা ওয়াফক বলতে শুধুমাত্র সাকিনে ওয়াকফ বুঝি। • মোটা পাতলা বলতে আমরা শুধু রা ও আল্লাহ শব্দের বারিক ও পুর বুঝি। বাস্তবে তা নয়। • মাদ্দের পরিমাণের ক্ষেত্রেও সুক্ষ্ম সুক্ষ্ম ভুল করি। • বিসমিল্লাহ ও আউযুবিল্লাহ্ পড়ার শুরুতে ও মাঝে কেন হবে? ইত্যাদি । তাঁরা বিধান জেনেশুনে তিলাওয়াত করেন, আর আমরা তিলাওয়াত করি অনেকটা আন্দাযের উপর। এতে আমাদের তিলাওয়াতের কাজটুকু হয় বৈ কি। কিন্তু বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করা হয় না। এমনকি পাঠ্যসিলেবাসেও জ্ঞানের অন্যান্য শাখার মত তাজভীদ অংশকে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয় না। অথচ এটা আমাদের প্রথম ও প্রধান জ্ঞান-উৎস ঐশীবাণী।