মানুষের যুক্তি-বুদ্ধির সঙ্গে নানাভাবে জড়িয়ে আছে ধাঁধা। ধাঁধা হল একটি খেলা যা একজন ব্যক্তির চাতুর্য বা জ্ঞান পরীক্ষা করে। ধাঁধা বিভিন্ন ধরনের রয়েছে, যেমন শব্দের ধাঁধা (শব্দজব্দ), শব্দ-অনুসন্ধান ধাঁধা, সংখ্যার ধাঁধা, সম্পর্কীয় ধাঁধা এবং যুক্তির ধাঁধা। ধাঁধা প্রায়শই বিনোদনের জন্য তৈরি করা হয়, তবে সেগুলি গুরুতর গাণিতিক বা যৌক্তিক সমস্যা থেকেও উদ্ভূত হতে পারে। ধাঁধা হলো প্রশ্ন ও জবাবের খেলা। মাথা খাটিয়ে শব্দ ও বাক্যের মারপ্যাঁচ থেকে খুঁজে বের করে আনতে হয় সঠিক উত্তর। জবাবে পাওয়া যেতে পারে প্রাকৃতিক উপাদান, সাংস্কৃতিক বস্তু, পৌরাণিক ব্যক্তি, স্থান কিংবা শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের নাম। ধাঁধার আছে অনেক রকম নাম। লৌকিক সংস্কৃতির সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত বলে ধাঁধার আঞ্চলিক নামও পাওয়া যায়। ময়মনসিংহ অঞ্চলে ধাঁধাকে বলা হয় ‘শিলক’। সম্ভবত ‘শ্লোক’ শব্দটি থেকে তৈরি হয়েছে ‘শিলক’। আবার কেউ শিল্লোকও ব্যবহার করেন। প্রমিত শব্দভাণ্ডারে ধাঁধার বিকল্প শব্দ হিসেবে আছে ‘হেঁয়ালি’ ও ‘প্রহেলিকা’। যে রচনা বা জিজ্ঞাসায় নিগূঢ় কোনো অর্থ নিহিত থাকে, সেটিই প্রহেলিকা। ধাঁধা বোঝাতে বাংলার কবি মুকুন্দরাম ‘প্রহেলিকা’ ও ‘হেঁয়ালি’ দুটো শব্দই ব্যবহার করেছেন। সত্যিকার অর্থে, ধাঁধা লৌকিক বিনোদনের মাধ্যম। আমরা এই গ্রন্থে গ্রাম বাংলার আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শিক্ষামূলক এবং বিনোদনমূলক ধাঁধাগুলোকে একত্রিত করার চেষ্টা করেছি মাত্র। এক্ষেত্রে কোন ধাঁধাটি কার লেখা সেদিকে নজর দেয়া হয়নি। মুরুব্বীদের কাছে গল্প শুনেছি, কয়েক দশক আগের কথা। বিবাহ সভায় বসে থাকতেন বর ও কনে। বর বেচারার বুদ্ধির পরীক্ষা নিতে ঠাট্টার সম্পর্কের আত্মীয়রা বরের উদ্দেশে ছুড়ে দিতেন নানা প্রশ্ন। চলত দুই পক্ষের বুদ্ধির বাহাস। বিয়ের আসরে ধাঁধার এই দ্বান্দ্বিকতা নতুন একটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্কেরও সূচনা করত। নতুন দুটি মানুষ, পরিবার ও অঞ্চলের মধ্যকার সেতুবন্ধনের সুযোগ তৈরি করে দিত বিদ্রুপময় ও বুদ্ধিদীপ্ত ধাঁধাগুলো। সেসময়ে বাঙালির আড্ডা জমে উঠত বাজারে, বৈঠকখানায়, খানকাহ ঘর বা অতিথিশালায়। ঝিম ধরা বৃষ্টির দিনে লাগামহীন চলত আড্ডা। সেসব অবসরে বুদ্ধির জোরে লোক হাসানো ও লোক ঠকানোর সৃষ্টিশীল উপায় ছিল ধাঁধা। আর ভেতরে ভেতরে তৈরি হয়ে যেত সামাজিক সম্পর্কের ভিত্তি।