"দেবদাস" বইয়ের ভূমিকা শরশ্চন্দ্রের সব উপন্যাস মধ্যবিত্ত শ্রেণির পুরুষ ও নারী চরিত্র নিয়ে লেখা হলেও তাদের জীবনের প্রেক্ষাপটে ছিল আধা সামন্ততান্ত্রিক ও আধা পুঁজিবাদী সমাজের নানা টানাপোড়েন। গ্রামীণ জীবনের অচলায়তন এবং শহরে আংশিক মুক্ত জীবনযাপনের মধ্যে ছিল দ্বন্দ্ব-সংঘাত। শরৎচন্দ্রের উপন্যাসে নারী-পুরুষের চরিত্রের জীবনে যে জটিলতা ও সমস্যা, তার পেছনে প্রায় ক্ষেত্রেই কারণ হিসেবে ক্রিয়াশীল এই দ্বন্দ্ব-সংঘাত। সমাজই তাঁর প্রায় সব উপন্যাসেই প্রধান পটভূমি। একমাত্র দেবদাস উপন্যাসেই তিনি সৃষ্টি করেছেন নায়ককেন্দ্রিক কাহিনি, যদিও এই নায়ক চরিত্রে সমাজনিরপেক্ষ হয়ে স্বাধীনভাবে আচরণ করতে পারেনি। যে বৈশিষ্ট্রের কারণে জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে দেবদাস শরৎচন্দ্রের অন্য উপন্যাসগুলোকে অতিক্রম করেছে, তা এর ট্র্যাজিক কাহিনি। তাঁর অন্য উপন্যাসে ট্র্যাজেডি এমন প্রাধান্য পায়নি। মূল চরিত্রের ট্র্যাজেডি বিশ্বাসযোগ্যভাবে আবেগের কাছে উপস্থাপনের কারণে দেবদাস সমকালে প্রবল জনপ্রিয়তার পাশাপাশি ধ্রুপদি উপন্যাসের মর্যাদাও লাভ করেছে। ধ্রুপদি সাহিত্যের আবেদন চিরকালের। দেবদাস যে ধ্রুপদি উপন্যাস, তার প্রমাণ এটি নিয়ে বিভিন্ন ভাষায় একের পর এক চলচ্চিত্র নির্মাণ এবং বইটি প্রকাশনার শতবর্ষে আবেগে-ভালোবাসায় স্মরণ।
শেষের কবিতা 'শেষের কবিতা' রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জনপ্রিয় বইগুলোর একটি। আমাদের দেশে অনেকগুলো সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে 'শেষের কবিতা'র। সবগুলো মানসম্পন্ন প্রকাশনা হয়েছে বলা যাবে না। প্রয়াত সব্যসাচী লেখক আবদুল মান্নান সৈয়দ এ-কারণে আমাদের উৎসাহ যুগিয়েছিলেন 'শেষের কবিতা'র একটি নির্ভুল, মানসম্পন্ন সংস্করণ 'সূচীপত্র' থেকে প্রকাশ করবার জন্যে। তিনি স্বউদ্যোগে একটি সুদীর্ঘ ভূমিকাও লিখে দিয়েছিলেন। (এমন কি বইয়ের মুল টেক্সটের ফাইনাল প্রুফও দেখে দিয়েছিলেন সতর্কতার শর্তে।) তাঁর লেখা এই ভূমিকাটাই আলাদা করে দিয়েছে সূচীপত্র সংস্করণের সঙ্গে বইবাজারে লভ্য আনান্য 'শেষের কবিতা'র।
বাঙালির জীবনের আনন্দ-বেদনাকে সাবলীল স্বচ্ছন্দ ভাষায় যে কথাশিল্পী পরম সহানুভূতি ভরে তুলে ধরেছেন বাংলা সাহিত্যে, তিনি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ১৮৭৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর, হুগলি জেলার ছোট্ট গ্রাম দেবানন্দপুরে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন শরৎচন্দ্র। দারিদ্র্যের কারণে তাঁর শৈশবকাল বলতে গেলে মাতুলালয় ভাগলপুরেই কেটেছে। দারিদ্র্যের কারণে ফি দিতে না পেরে বেশ কয়েকবার স্কুল বদলিও করতে হয়েছিলো ছোটবেলা থেকেই দুরন্ত ও মেধাবী শরৎচন্দ্রের। এন্ট্রান্স পাস করে কলেজে ভর্তি হলেও এফএ পরীক্ষার ফি জোগাড় করতে না পেরে পরীক্ষায় বসতে পারেননি। দারিদ্র্য যখন শিক্ষাজীবনে অব্যহতি টানলো, তারপরই শুরু হলো আপাত সাধারণ এই মানুষটির বর্ণাঢ্য কর্ম ও সাহিত্যজীবন। এ সময় প্রতিবেশী বিভূতিভূষণ ভট্টের বাড়িতে আয়োজিত সাহিত্যসভায় লেখালেখির অনুপ্রেরণা ফিরে পেলেন যেন আবার। যার ফলশ্রুতিতে বাংলা সাহিত্য পেয়েছিলো বড়দিদি, দেবদাস, চন্দ্রনাথ, শুভদা’র মতো কালোত্তীর্ণ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর উপন্যাস সমগ্র। কাছাকাছি সময়ে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ছোটগল্প অনুপমার প্রেম, আলো ও ছায়া, হরিচরণ, বোঝা ইত্যাদি রচিত হয়। বনেলী রাজ স্টেটে সেটলমেন্ট অফিসারের সহকারী হিসেবে কিছুদিন কাজ করেন এসময়। কিন্তু তারপরই বাবার উপর অভিমান করে সন্ন্যাসদলে যোগ দিয়ে গান ও নাটকে অভিনয়ে মনোনিবেশ করেন। কখনও কলকাতা হাইকোর্টের অনুবাদক, আবার বার্মা রেলওয়ের হিসাব দপ্তরের কেরানি হিসেবেও কাজ করেন শরৎচন্দ্র। রাজনীতিতেও সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন ১৯২১ সালে কংগ্রেসের অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়ে, এবং হাওড়া জেলা কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হয়ে। এর মাঝে নিরন্তর চলেছে নিজস্ব জীবনবোধ ও অভিজ্ঞতা উৎসারিত সাহিত্যচর্চা। সমষ্টি আকারে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় গল্প সমগ্র বিন্দুর ছেলে ও অন্যান্য, শ্রীকান্ত-৪ খন্ড, কাশীনাথ, ছেলেবেলার গল্প ইত্যাদি সময় নিয়ে প্রকাশিত হলেও পেয়েছিলো দারুণ পাঠকপ্রিয়তা। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর বই সমূহ বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে, এবং বিশ্বব্যাপী পাঠকের কাছে হয়েছে সমাদৃত। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর বই সমগ্র দেবদাস, শ্রীকান্ত, রামের সুমতি, দেনা-পাওনা, বিরাজবৌ ইত্যাদি থেকে বাংলাসহ ভারতীয় নানা ভাষায় নির্মিত হয়েছে অসাধারণ সফল সব চিত্রনাট্য ও চলচ্চিত্র। সাহিত্যকর্মে অসাধারণ অবদানের জন্য এই খ্যাতিমান বাংলা সাহিত্যিক কুন্তলীন পুরস্কার, জগত্তারিণী স্বর্ণপদক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিলিট উপাধি লাভ করেন। ১৯৩৮ সালের ১৬ জানুয়ারি কলকাতায় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।