১৯৫০-৭০। বাঙালির ইতিহাসের এক ক্রান্তিকালে আমার জন্ম ও বেড়ে-ওঠা। গ্রামবাংলার মোহনীয় প্রকৃতির কোলে মানুষের ভালোবাসায় আমার শৈশব ও কৈশোরের আনন্দঘন আশ্চর্য দিনগুলি কেটেছে। তারপর মানুষের জীবনের মান এবং বাঁচার পরিবেশ চোখের সামনে দ্রুত পড়ে যেতে দেখেছি। ঐ বিচিত্র খরস্রোতা সময়ের খণ্ড খণ্ড এবং বিচ্ছিন্ন চিত্র এ বই। এখানে আমি আত্মজীবনী বা ইতিহাস লেখার চেষ্টা করিনি। যৌবনে স্বপ্ন ও সম্ভাবনার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বিক্ষুব্ধ স্বদেশকে আবিষ্কার করেছিলাম। জাতিগতভাবে বাঙালি হবার কারণে আমাদের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতি পাকিস্তানি শোষণ ও শাসনের অনবরত হামলার শিকার। এ থেকে মুক্তির পথ জনতার সঙ্গে আমিও খুঁজছিলাম। পথ দেখালেন বাঙালির ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ঝাঁপিয়ে পড়লাম বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালির মুক্তিসংগ্রামে। এখানে কর্মী হিসেবে বঙ্গবন্ধু আমাকে খুঁজে পাবার আগে আমিই তাঁকে নেতা হিসেবে আবিষ্কার করেছিলাম। '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির গৌরবের উজ্জ্বলতম অধ্যায়। আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের মতো এর ক্ষেত্র তৈরি হয়েছিল দীর্ঘকাল ধরে। আমাদের জাতীয় মুক্তি-আন্দোলনের এ অধ্যায়কে নাম দেয়া হয়েছে 'মুক্তিসংগ্রাম'। এই মুক্তিসংগ্রামেরই চূড়ান্তরূপ '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ। '৫২'র ভাষা আন্দোলন, '৫৪'র নির্বাচন, '৬২'র শিক্ষা-আন্দোলন, '৬৬'র ৬-দফা, '৬৮'র আগরতলা ষড়যন্ত্র-মামলা-বিরোধী বিক্ষোভ, '৬৯'র ১১-দফা আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান, '৭০'র নির্বাচন প্রভৃতি ঘটনা ও আন্দোলন তরঙ্গের পর তরঙ্গাঘাতে বাঙালিকে মুক্তিযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়। এসব ঘটনা না হলে ২৫শে মার্চ রাতের আঁধারে ঘুমন্ত বাঙালির উপর পাকিস্তানের কাপুরুষ সেনাবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ত না এবং তার প্রতিরোধে অস্ত্রধরার প্রয়োজনও হতো না বাঙালির। দুর্ভাগ্য! আমাদের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ ও মূল্যায়িত হয়নি। ঘটনাগুলি খুব দ্রুত ঘটেছিল। গণজীবনে তার স্থায়ী প্রভাব অনুভূত হবার আগেই মুক্তিযুদ্ধের মতো বিরাট বিশাল প্রচণ্ড প্রলয়ংকরী ঘটনা এসে সব তোলপাড় করে দিলো। মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয়ের পরম ও তাৎক্ষণিক গৌরব আমাদের দীর্ঘকালের মুক্তিসংগ্রামের খণ্ড খণ্ড গৌরবগুলিকে গৌণ করে দেয়। নতুন প্রজন্মের হাতে মুক্তিযুদ্ধ ও তার পূর্ববর্তী অধ্যায় মুক্তিসংগ্রামের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস তুলে দিতে হবে। তাদের জানাতে হবে ছাত্র-জনতা এবং তাদের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিসংগ্রামকে কীভাবে ধাপে ধাপে মুক্তিযুদ্ধের দিকে নিয়ে গেলেন এবং কীভাবে আমার মতো সাধারণ ছাত্ররা মহান মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে গেল। এ বইয়ে আমার অভিজ্ঞতার বিবরণ থেকে পাঠকেরা তার কিছুটা আন্দাজ পাবেন। 'স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে'-এমন কথাটি খুব বেশি অতিশয়োক্তি নয়। আমি সে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। আমরা বিভিন্ন ছাত্রাবাস (হল) থেকে গিয়ে কীভাবে মুক্তিসংগ্রামে অংশ নিতাম তার কথাও বলেছি এ বইয়ে। ছাত্র-আন্দোলনের কারণেই আমার এ প্রিয় প্রতিষ্ঠান এবং তার ছাত্রাবাসগুলি ২৫শে মার্চের কালো রাতে হানাদার বাহিনীর আক্রোশের প্রধান লক্ষ্য ছিল। প্রায় চার দশক পরে স্মৃতির ওপর নির্ভর করে কোনোকিছু লেখা অতি ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। স্মৃতিশক্তি কীভাবে কাজ করে বিজ্ঞানীরা আজও তা নিশ্চিতভাবে জানতে পারেনি। যেটুকু জানা গেছে সে অনুযায়ী স্মৃতি ধরে রাখার জন্যে মস্তিষ্কের জীবকোষে সীমিত ধারণক্ষমতা আছে। স্মৃতির ভান্ডার পূর্ণ হলে কম-গুরুত্বের স্মৃতিগুলি তলিয়ে যায় এবং অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতিগুলির জায়গা হয় এ নিয়মে সাহস করে বলতে পারি, আমার স্মৃতিতে যা জমা আছে তা আমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
ড. নূরুন নবী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাণরসায়ন বিষয়ে বিএসসি (অনার্স) এবং এমএসসি, জাপানের ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পােস্ট গ্রাজুয়েট ডিপ্লোমা, কিউশু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচ-ডি, আমেরিকার নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে পােস্ট ডক্টোরাল। '৭০ দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং প্রথম সিনেটের সদস্য। ১৯৮০ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস। পেশায় গবেষক-বিজ্ঞানী, বর্তমানে একটি বহুজাতিক কোম্পানির শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞানী হিসেবে অবসর গ্রহণ করেছেন। ড. নূরুন নবীর পেটেন্টকৃত আবিষ্কারের বর্তমান সংখ্যা ৫৫। বিজ্ঞানের পেশাদারী জার্নালে এ যাবৎ তাঁর ৫০টি গবেষণা-নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ফজলুল হক হল শাখার সভাপতি (১৯৬৭-৭১), মুক্তিসংগ্রামের দিনগুলিতে নিবেদিতপ্রাণ ছাত্রকর্মী, ১৯৭১-এর বীর মুক্তিযােদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের কিংবদন্তি টাঙ্গাইলের বাঘা সিদ্দিকীর ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত সহযােদ্ধা, ফারইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউ বর্ণিত টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনীর ‘ব্রেইন’, মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য প্রধান সেনাপতি কর্তৃক প্রদত্ত ‘স্পেশাল সাইটেশন প্রাপ্ত।