অমসৃণ যুযুুধান সময়ের চড়াই- উতরাইকে ধরতে শত শত বার বাংলা, বাঙালির থিয়েটার ফিরেছে রবীন্দ্রনাথে। ফিরে গেছে তাঁর লেখা অনন্য-অসাধারণ এক নাটকের কাছে। রচনাকালে যার নাম ছিল ‘যক্ষপুরী’। পাণ্ডুলিপিতে নামবদল, ‘নন্দিনী’। প্রবাসীতে প্রকাশকালে ফের শিরোনামে বদল, রক্তকরবী। ১৯২৬ সালের ডিসেম্বরে যার গ্রন্থাকারে আবির্ভাব। সৌন্দর্য ও স্বাভাবিক বিকাশের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে অসীম লোভ যে শোষণে, অত্যাচারে আর নিপীড়নে বহাল রাখে অচলায়তন তারই রূপক রক্তকরবী। জীবনের প্রকাশের শুদ্ধতর রূপ- প্রেম ও সৌন্দর্য। রক্তকরবীর নন্দিনী তারই প্রতীক। যার আনন্দস্পর্শ রাজা পায়নি লোভের মোহে, সন্ন্যাসী পায়নি ধর্মসংস্কারের মোহে, মজুররা পায়নি অত্যাচার ও অবিচারের লোহার শিকলে বাঁধা পড়ে, পণ্ডিত পায়নি দাসত্বের মোহে। দেশ-কাল-সময়ের বেড়া ঠেলে রক্তকরবী যেন অতি চেনা এক গল্প বলে। এ দেশ, নয়তো পাশের দেশ। কিংবা তারও পাশের দেশ। যদিও যক্ষপুরীর লৌহ-যবনিকার কঠিন প্রান্তরে নন্দিনীর হাতছানিতেই আসে মুক্তি, জীবনানন্দ। বাঙালির অস্তিত্বের সঙ্গী রবীন্দ্র-সাহিত্যের তুলনারহিত এক নিদর্শন রক্তকরবী। বারে বারে যা অন্ধকার হতে আলোর পথে অভিযাত্রারই সংকেত দিয়ে যায়। যার প্রতিটি ছত্রে, বাক্যে জড়-যান্ত্রিকতা আর জীবনধর্মের মধ্যে সামঞ্জস্যের সন্ধান করেছেন জীবনবাদী রবীন্দ্রনাথ।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একাধারে ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার, চিত্রশিল্পী, সংগীতস্রষ্টা, অভিনেতা, কন্ঠশিল্পী, কবি, সমাজ-সংস্কারক এবং দার্শনিক। গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য প্রথম বাঙালি হিসেবে ১৯১৩ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬১ সালের ৭ মে তৎকালীন ব্রিটিশ-শাসিত ভারতে কলকাতার ধনাঢ্য ও সংস্কৃতিমনা জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব থেকেই তিনি লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন। ভানুসিংহ ঠাকুর ছিল তাঁর ছদ্মনাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই মানেই এক মোহের মাঝে আটকে যাওয়া, যে মোহ পাঠককে জীবনের নানা রঙের সাথে পরিচিত করিয়ে দেয় নানা ঢঙে, নানা ছন্দে, নানা সুর ও বর্ণে। তাঁর ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাট্যগ্রন্থ, ১৩টি উপন্যাস, ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসংকলন জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর কিছুদিন পরই আলোর মুখ দেখে। কাবুলিওয়ালা, হৈমন্তী, পোস্টমাস্টারসহ মোট ৯৫টি গল্প স্থান পেয়েছে তাঁর ‘গল্পগুচ্ছ’ গ্রন্থে। অন্যদিকে ‘গীতবিতান’ গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে ১,৯১৫টি গান। উপন্যাস, কবিতা, সঙ্গীত, ছোটগল্প, গীতিনাট্য, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনীসহ সাহিত্যের সকল শাখাই যেন ধারণ করে আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই সমূহ। তিনি একাধারে নাট্যকার ও নাট্যাভিনেতা দুই-ই ছিলেন। কোনো প্রথাগত শিক্ষা ছাড়া তিনি চিত্রাংকনও করতেন। তৎকালীন সমাজ-সংস্কারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন এই গুণী ব্যক্তিত্ব। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাতেই অনূদিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই সমগ্র। তাঁর যাবতীয় রচনা ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’ নামে ত্রিশ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট জোড়াসাঁকোর বাড়িতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর পর এতদিন পেরিয়ে গেলেও তাঁর সাহিত্যকর্ম আজও স্বমহিমায় ভাস্বর। আজও আমাদের বাঙালি জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে বিশ্বকবির সাহিত্যকর্ম।