রাসূল (দ.) ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের ইমামতের ধারায় বিশ্বাসী সাইয়্যেদ আব্দুল হুসাইন শারাফুদ্দিন আল্ মূসাভি (১২৯০-১৩৭৭ হিজরি) ছিলেন একজন বিখ্যাত মুজতাহিদ। তিনি ছিলেন ইসলামি মাজহাবগুলোর মধ্যে ঐক্য ও সংহতি স্থাপনের একজন বলিষ্ঠ রূপকার। শিয়া ও সুন্নী মুসলিমদের মধ্যে বিরাজমান চিরাচরিত বিতর্কের অবসান ঘটিয়ে এ দুই মাজহাবের মধ্যে সুদৃঢ় ঐক্য স্থাপনে তিনি উদ্যমী ভূমিকা পালন করেছেন। একইসাথে, লেবাননের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্বদানকারী তেজস্বী নেতা হিসেবেও সাইয়্যেদ শারাফুদ্দিনের ব্যাপক সুখ্যাতি ছিল। তাঁর লেখনির মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দুটি গ্রন্থ হল *আল্ মুরাজিআত* ও *আন্-নাস ওয়াল ইজতিহাদ* যেখানে সম্পূর্ণ যৌক্তিক প্রমাণের ভিত্তিতে ও অসামান্য পান্ডিত্যের মাধ্যমে আহলে বাইতের অনুসারিদের প্রকৃত আক্বিদা-বিশ্বাস সম্পর্কে বিস্তর আলোচনা করা হয়েছে। এ গ্রন্থ দুটি আন্তজার্তিক সীমারেখা অতিক্রম করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং তা সারা বিশ্বের সকল মাজহাবের মুসলিমদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। সাইয়্যেদ শারাফুদ্দিনের নৈকট্যতম শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন আল্-আখুন্দ আল্-খুরাসানি, আল্-শায়খ আল্-শারিআ আল্-ইসফাহানি, আস্-সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ কাযিম আত্-তাবাতাবাঈ আল্-ইয়াযদি ও মির্যা হুসাইন আন্-নূরী। ১৩২৯ হিজরির প্রাক্কালে ইতিহাস-সমৃদ্ধ মিশরের খ্যাতনামা পন্ডিত, গবেষক ও লেখকদের সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে সাইয়্যেদ শারাফুদ্দিন এক ঐতিহাসিক সফরে বের হন। তাঁর মূল লক্ষ্য ছিল— শিয়া ও সুন্নী মুসলিমদের মধ্যে পারস্পরিক আলোচনা ও মতবিনিময়ের মাধ্যমে সৌহার্দ্যপূর্ণ ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্য প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করা। এসময় তিনি মিশরের আল্-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য মুফতি শায়খ আল্-বিশরির সাক্ষাত পান। শায়খ আল্-বিশরি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের একজন বিখ্যাত পন্ডিত ছিলেন। এ পরিচয়ের পরিক্রমায় পরবর্তিতে এ দুই পন্ডিতের মধ্যে ১১২টি পত্রের আদান-প্রদানের মাধ্যমে শিয়া ও সুন্নী মাজহাবের বিভিন্ন বিষয়বস্তু সম্পর্কে গবেষণাধর্মী আলোচনা ও পারস্পরিক মতাদর্শের বিনিময় হয়। এর বিষয়বস্তুসমূহের মধ্যে মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর ইন্তেকালের পর খিলাফতের মসনদে অভিষিক্ত হওয়ার বিষয়টি চমকপ্রদভাবে বিস্তারিত আলোচনার দ্বার উন্মোচন করে দেয়। এ দুই পন্ডিতের উভয়েই পারস্পরিক মতের প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধাশীলতা, সহিষ্ণুতা, সহনশীলতা, ও সহানুভূতিশীলতা প্রদর্শণের মাধ্যমে পত্রযোগেই গভীর বিতার্কিক আলোচনায় নিমজ্জিত হন। তাঁদের সকল কথাবার্তা ও যুক্তি ছিল প্রমাণভিত্তিক ও গবেষণাধর্মী। তৎকালীন সময়ে তাঁদের মধ্যকার আলোচনার রেশ ধরে যতগুলো পত্রের আদান-প্রদান হয়েছিল, তা ২৫ বছর পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশ করা হয়। এ গ্রন্থটিই *আল্ মুরাজিআত* নামে পরিচিত। এ গ্রন্থটিতে সাইয়্যেদ আব্দুল্ হুসাইন শারাফুদ্দিন আল্-মূসাভি ও আল্-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের মুফতি শায়খ সালিম আল্-বিশরির মধ্যে আদান-প্রদানকৃত ১১২ টি পত্র উপস্থাপন করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যকার এসব পত্রসমূহে খিলাফত ও ইমামতের বিষয়ে আহলে বাইতের অনুসারীদের দৃষ্টিভঙ্গি সুবিন্যস্ত হয়েছে; এবং শিয়া-সুন্নী বিতর্কের বিসয়বস্তুগুলোর প্রামাণিক বিশ্লেষণ করা হয়েছে। আর এসব পত্রসমূহের সকল বিশ্লেষণে ও সমালোচনায় পবিত্র ক্বোরআন হতে ও আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের নির্ভরযোগ্য সূত্রের হাদিসসমূহ হতে উদ্ধৃতি প্রদান করা হয়েছে।