মুকুল রায় সাহিত্যিক ও শিশুসাহিত্যিক হলেও মূলত একজন কবি। আর স্বভাবজাত কবির মতই তিনি দৃশ্যপটের বাইরে নিভৃতচারী, নির্ঝঞ্ঝাট, প্রচারবিমুখ এবং নিঃসঙ্গ থাকতেই বেশি পছন্দ করেন। তাই তাঁর পরিচিতির ব্যাপ্তিও তুলনামূলকভাবে সীমাবদ্ধ! এই গ্রন্থ 'আসাম ভ্রমণ উপাখ্যান' তাঁর তৃতীয় ভ্রমণকাহিনী। তাঁর ভ্রমণ-গ্রন্থগুলো আর দশটি 'ভ্রমণ-কাহিনী'র মত শুধু যাতায়াত আর দেখার কাহিনী মাত্র নয়! এই রচনায় চোখের দেখা ছাড়াও থাকে অনুভব, দর্শন, ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং একটি বিবাগী মন ও মননের অভিব্যক্তির পরিস্ফুটন! উল্লেখ্য যে, অসমিয়া ও ইংরেজি ভাষায় অনুদিত তাঁর আসামের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, জনবিন্যাস, ভাষা ও প্রকৃতির বিষয়াদির তথ্যসহ লেখা প্রথম ভ্রমণকাহিনী 'বাগেশ্বরী পাহাড়'কে আমি নামকরণ করেছিলাম 'ভ্রমণোপন্যাস', কারণ এই কাহিনীতে 'ভ্রমণ'কে ছাপিয়েও জেগে উঠেছিল এক অসমিয়া মেয়ের সাথে ভ্রমণকারীর এক গূঢ় মানবিক প্রেমের সম্পর্ক! মুকুল রায়ের 'বাগেশ্বরী পাহাড়' ভ্রমণোপন্যাসটি অসমিয়া ভাষায় অনুদিত হয়। বইটির মোড়ক উন্মোচন করা হয় ২০১৬ এর ডিসেম্বরে আসামের রাজধানী গৌহাটিতে। সেই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত হয়ে সংবর্ধনা নিতে যাবার কাহিনীই এই গ্রন্থ 'আসাম ভ্রমণ উপাখ্যান'- এর প্রথম খন্ডের উপজীব্য! সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশে সংবর্ধনা নিতে গেলে যে উর্ধতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি গ্রহণ বাধ্যতামূলক, সেই সরকারি ছুটি-প্রাপ্তি বিষয়ক টানাপোড়েনের নবতর অভিজ্ঞতা দিয়ে এই বইটির কাহিনীর শুরু। আবার আকাশপথে বিমানযাত্রার বিবিধ সংকট ও উপলব্ধি দিয়ে শেষ ! মজার বিষয় হলো যে, নিজেই মধ্যম-সারির একজন আমলা হয়েও তিনি এদেশের শক্তিশালী আমলাতন্ত্রের যে স্বরূপ উদ্ঘাটনের চেষ্টা করেছেন, সেই অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি এই বইটিকে এক নতুন মাত্রা দিয়েছে। এই আকাশযাত্রায় অন্ধকার রাতে বিমানের ঝড়ের কবলে পড়ে জীবন-মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়া থেকে শুরু করে দিনের আলোতে মহাকাশের স্তরের পর স্তর অতিক্রম করে উপরে উঠে পৃথিবী থেকে ভারশূন্য হয়ে দিব্যদৃষ্টির মত মহাকালের অনন্ত ও অনাদি বিশ্বরূপ-দর্শনের পর চিন্তাচেতনা ও উপলব্ধির যে ব্যাপ্তি ঘটেছে, তা পাঠ করতে করতে পাঠককের মনেও সংক্রমিত হয় এক নবতর চেতনার আবহ! এভাবেই মুকুল রায় তার অন্য দুটি ভ্রমণকাহিনী 'বাগেশ্বরী পাহাড়' এবং 'সুন্দরীদের দেশে'র মতই এই ভ্রমণকাহিনীতেও তাঁর দৃষ্টিকে অন্তর্দৃষ্টিতে পরিব্যাপ্ত করে অন্যমাত্রা সংযোজন করেছেন! ভ্রমণকাহিনী পাঠে আগ্রহী পাঠকদের কাছে মুকুল রায়ের চমৎকার এই তৃতীয় ভ্রমণ-গ্রন্থ 'আসাম ভ্রমণ উপাখ্যান'টি জনপ্রিয়তা পাবে বলে মনে করি। বইটি বহুল প্রচারিত হোক।