হযরত আদম ও হাওয়া (আ)—কে জান্নাত থেকে পৃথিবীতে পাঠাবার প্রাককালে মহান আল্লাহ বলেন, আমার পক্ষ থেকে পথনির্দেশ যেতে থাকবে। যারা আমার পথনির্দেশের অনুগামী হবে তারা শংকিত ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হবে না। আর যারা সেই পথনির্দেশ অমান্য করবে এবং আমার বাণীকে মিথ্যাচারে আবৃত করবে তারা হবে দোযখের স্থায়ী বাসিন্দা। যুগে যুগে নবী—রাসূলগণের মাধ্যমে প্রাপ্ত পথনির্দেশের ভিত্তিতে মহান ¯্রষ্টায়, নবী—রাসূলগণে, আসমানী কিতাবে এবং পার্থিব জীবনের পর অনন্ত জীবন লাভের ওপর মানবজাতির মনের মুকরে এক অবিচল বিশ্বাস বদ্ধমূল হয়েছে। তার এই বিশ্বাস এতোই পোক্ত ও পরিপক্ক যে, সে কঠিন প্রতিকূল পরিস্থিতির শিকার হয়েও জীবন বিসর্জন দেয় কিন্তু ঈমান বিসর্জন দেয় না । আল—কুরআনের আলোকে মুসলিম উম্মাহ্র মধ্যে বিশ্বাসের যে সেতুবন্ধন রচিত হয়েছে তাই হচ্ছে এই গ্রন্থের আলোচ্য বিষয়। এই সেতুবন্ধনের যে কোনো একটি গিট দুর্বল হয়ে পড়লে ঈমানও দুর্বল হতে থাকে এবং তা খুলে গেলে ঈমান থেকে বিচ্যুতি ঘটে। আলোচ্য গ্রন্থখানি ইমাম আজম আবু হানীফা (র)—এর আকর গ্রন্থ আল—ফিকহুল আকবার পুস্তিকার ভাষ্যগ্রন্থ ‘আকীদাতু আহলিস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াত’ গ্রন্থের পরিপুষ্ট ভাষ্যগ্রন্থ ‘শারহু আকীদাতিত তহাবিয়া’—এর বাংলা অনুবাদ। গ্রন্থকার ঈমান ও আকীদার বিষয়সমূহ পর্যায়ক্রমে আলোচনা করেছেন। যেমন আমরা লক্ষ করি যে, গ্রন্থকার সর্বপ্রথম মহান ¯্রষ্টা আল্লাহ রব্বুল আলামীনের ওপর ঈমান আনয়ন সম্পর্কে বিস্তরিত আলোচনা করেছেন। এ সম্পর্কে মানবজাতির মধ্যে যে ভ্রষ্ট বিশ্বাসের (শিরক) অনুপ্রবেশ ঘটেছে তার অসারতা কুরআন—সুন্নাহ ও যুক্তি—বুদ্ধির আলোকে প্রমাণ করা হয়েছে। যারা শিরক—এ লিপ্ত হয়েছে তাদের ধারণা হলো, মানুষ সসীম সৃষ্টি এবং আল্লাহ অসীম ¯্রষ্টা। অসীমের কাছে সসীমের গমন মাধ্যম ছাড়া সম্ভব নয়। কিন্তু আল্লাহ তাঁর বান্দাদের বলে দিলেন: “আমরা তোমারই ইবাদত করি। তোমার কাছেই সাহায্য চাই। আমাদেরকে সহজ সরল পথ দেখাও”। কোনো মাধ্যমের প্রয়োজন নেই। তিনি মানুষের মধ্যে এমন এক অন্তরাত্মা দান করেছেন যার কোথাও যেতে বাহনের প্রয়োজন হয় না। আল—কুরআনের বহু স্থানে আল্লাহ তায়ালা ঈমানের সাথে তার অপরিহার্য পরিপূরক হিসেবে আরো একটি বিষয় যুক্ত করেছেন। তা হলো ‘আমলে সালেহ’। তথা সৎকাজ, উত্তম কাজ, উপকারী ও কল্যাণকর কাজ। ইসলামী শরীয়াতের নীতি—আদর্শ ও নিয়ম অনুসারে যে কোনো উপকারী ও কল্যাণপ্রসূ কথা, কাজ ও আচরণকে আমলে সালেহ বলে। ধর্ম—বর্ণ নির্বিশেষে সকলের নিকট তা ‘সৎকাজ’ হিসেবে পরিচিত। এটি একটি ব্যাপক অর্থবোধক পরিভাষা। ইহ—পরকালের সৌভাগ্য অর্জন ঈমানের ভিত্তিতে সৎকাজ সম্পাদনের ওপর নির্ভরশীল। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন: “কোনো ঈমানদার পুরুষ অথবা নারী সৎকাজ করলে আমি অবশ্যই তার পবিত্র জীবন যাপনের ব্যবস্থা করবো এবং তাদেরকে তাদের কৃত কার্যাবলীর তুলনায় অধিক উত্তম প্রতিদান দেবো” (১৬:৯৭)। “আর কেউ ঈমান এনে সৎকাজ করলে তার জন্য রয়েছে সর্বাধিক চমৎকার পুরস্কার এবং আমি তার সাথে ব্যবহারে ন¤্রতা অবলম্বন করবো” (১৮:৮৮)। “আর যে ব্যক্তি তওবা করে, ঈমান আনে এবং সৎকাজ করে, অতঃপর সৎপথে চলে আমি তার জন্য অবশ্যই ক্ষমাশীল” (২০:৮২ ; আরো দ্র. ২৫:৭০ ; ২৮:৬৭—৮০ ; ৪০:৪০ ; ৬৪:৯ ইত্যাদি আয়াতসমূহ)। মুসলমান হোক বা ভিন্ন ধর্মাবলম্বী, কেউ সৎকাজ করলে তার প্রতিদান প্রাপ্ত হবে। মহানবী (সা) বলেন, যে কোনো মুসলমান বা কাফের (ভিন্ন ধর্মাবলম্বী) উত্তম কাজ করলে সে অচিরেই তার পার্থিব জীবনে অথবা অচিরেই তার আখেরাতের জীবনে এর পুরস্কার প্রাপ্ত হবে” (মাজমাউয যাওয়াইদ)। অপরিহার্য আনুষ্ঠানিক ইবাদতসমূহের পরপরই আমলে সালেহ—এর গুরুত্ব। তার মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে মানবসেবা। তার মধ্যে সর্বপ্রধান ও সর্বাগ্রগণ্য হচ্ছে ‘মাতা—পিতার সাথে সদাচার, তাদের ভরণপোষণের ব্যবস্থা ও প্রয়োজনাদি পূরণ করা , এমনকি তারা ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হলেও (দ্র. ৩১:১৪—১৫)। অতি সাধারণ সৎকাজ হচ্ছে চলাচলের পথ থেকে কষ্টদায়ক বস্তু অপসারণ করা। অতঃপর নবুওয়াত ও রিসালাত এবং বিশেষভাবে মহানবী (সা)—এর রিসালাত এবং কুরআন মজীদ ফেরেশতাকুল আসমানী কিতাবসমূহ এক কথায় সূচিপত্রের ওপর চোখ বুলালেই পাঠকগণ আলোচ্য গ্রন্থের বিষয়বস্তু সম্পর্কে ধারণা লাভ করেতে পারবেন। কিতাবটি অনুবাদ করেছেন যথক্রমেÑ মাওলানা জাকের উল্লাহ আবুল খায়ের, মাওলানা সানাউল্লাহ নজির আহমদ, মাওলানা এ কে এম আবদুর রশিদ আল—মাদানী, মাওলানা নো‘মান আবুল বাশার, মাওলানা শাহজাহান আল—মাদানী, মাওলানা বজলুর রহমান আল—মাদানী, মাওলানা সামাউন আলী আল—মাদানী। মাওলানা মুহাম্মদ মূসা কিবাতটিকে সিদ্ধহস্তে সম্পাদনা করেছেন। তাঁর দক্ষ সম্পাদনায় কিতাবটি যথার্থ হয়ে ওঠেছে।