বিশ্বব্যাপী মুসলমান প্রধান সমাজে বর্তমান সময়ে ইসলামের পুনর্জাগরণের একরূপ আকুতি আছে। যার ছাপ পড়েছে দক্ষিণ এশিয়ার সামাজিক জীবনে এবং মানুষের পঠন-পাঠনেও। এখানে রাষ্ট্রনৈতিক ইসলামের অন্যতম প্রভাবশালী এক চরিত্র মাওলানা আবুল আ’লা মওদূদী (১৯০৩-১৯৭৯ খ্রি.)। তাঁর রাষ্ট্রচিন্তার উপর পড়তে এবং লিখতে গিয়ে ইসলাম বিষয়ে ভাবুকদের দুটি অর্থনৈতিক পর্যবেক্ষণ নজরে আসে। মওদূদীর লেখনীসহ রাজনৈতিক ইসলামের প্রায় অধিকাংশ প্রভাবশালী ভাষ্যে এই ধর্মের সঙ্গে পুঁজিতন্ত্রের শক্ত বৈপরীত্যের কথা দাবি করা হয়েছে। এরকম ভাষ্যকাররা পুঁজিতন্ত্রের তীব্র সমালোচনা করেছেন। তাঁরা সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদেরও সমালোচনা করেছেন। আবার অপর একদল ভাবুক ইসলামে সাম্যবাদী ভাবাদর্শের নজিরও দেখান। শেষোক্ত ঘরানার অর্থনৈতিক চিন্তায় এমন একটা সংখ্যালঘু ভাষ্যও রয়েছে, আদিতে এই ধর্মে সমতাবাদী অর্থনৈতিক চিন্তার আধিপত্য ছিল। ক্রমে তা থেকে বিচ্যুতি ঘটেছে। এই ভাষ্যকাররা তাঁদের আলোচনায় গুরুত্ব দিয়ে হাজির করেন হযরত আবুজর রা. এর জীবন কাহিনি এবং অর্থনৈতিক সমতাবাদের পক্ষে তাঁর ভ‚মিকার কথা। একটা ন্যায্য সমাজ গড়ার সংগ্রামে একালে পুঁজিতন্ত্র নিয়ে অনেকেই পুনর্ভাবনা করছেন। সাম্যবাদীরাও তাঁদের মতাদর্শের গত শতাব্দীর ব্যবহারিক অভিজ্ঞতাগুলো পর্যালোচনা করছেন। পুঁজিতন্ত্র ও স� �ম্যবাদী রাজনৈতিক-অর্থনীতির এরকম ভাবনা-পুনর্ভাবনার মাঝে অবস্থান করেও অগ্রসর একটা রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়তে হলে ইসলামের অনুসারীদেরও নিশ্চয়ই নিজেদের অর্থনৈতিক ইতিহাসের নির্মোহ পর্যালোচনা দরকার আছে। বিশেষ করে এটা দেখা দরকার, ইসলামি অর্থনৈতিক চিন্তার উপরোক্ত দুই ধারা প্রকৃতই কী বলতে চেয়েছে? ইসলাম কি পুঁজিতন্ত্রবিরোধী অবস্থান নিয়েছিল আদিতে? কিংবা এই ধর্মের অর্থনৈতিক নীতি-আদর্শ প্রণয়নকারীদের মূলধারা কি সাম্যবাদী উৎপাদন সম্পর্কের প্রচারকারী ছিলেন? এই দুই প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধানের সীমিত চেষ্টা বর্তমান অনুসন্ধান। পুরো আলোচনায় মূলত হযরত আবুজর রা.কে কেন্দ্রে রেখে প্রাথমিক ইসলামের অর্থনৈতিক গতিপ্রকৃতিকে বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে। আবার অর্থনৈতিক গতিপ্রকৃতির ভেতর দিয়ে প্রাথমিক ইসলামের প্রকৃতিও অনুধাবনের চেষ্টা করা হয়েছে। তবে সকল আলোচনাই হবে মূলত আবুজর গিফারী রা.-এর অর্থনৈতিক চিন্তাধারা বুঝতে গিয়ে। এটা সবার জানা, হযরত মুহাম্মদ সা. মারা যাওয়ার সময় বিপুল সংখ্যক সাহাবা বা সহচর রেখে গেছেন। এদের মধ্যে আবুজর গিফারী রা. প্রশাসনিক বা নীতিনির্ধারণী বিবেচনায় নেতৃস্থানীয় সাহাবা ছিলেন না। তবে ইসলামের ইতিহাসবিদদের কাছে ন্যায়বিচারের প্রসঙ্গ উঠলে যে কয়জন সাহাবার নাম বেশি উচ্চারিত হয় আবুজর রা. তাঁদের একজন। তাঁর জীবনকে কেন্দ্র করে প্রাথমিক ইসলামে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কিছু বিতর্ক সামনে এসেছিল। সেজন্য ইসলামের ইতিহাসে তিনি এক বিশেষ চরিত্র। একই কারণে এই লেখায় আবুজর রা.কে পর্যালোচনার উপলক্ষ হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে। তবে এরকম অনুসন্ধানের প্রধান সমস্যা হলো আবুজর রা. সম্পর্কে ইসলামের ইতিহাসে তথ্য-উপাত্তের বিস্ময়কর ঘাটতি আছে। যদিও ইদানীং বিশ্বজুড়ে মুসলমান-সমাজে হযরত মুহাম্মদ সা. এবং তাঁর সময়কার ইসলাম সম্পর্কে জানার আগ্রহের এক ধরনের নবতরঙ্গ চলছে, কিন্তু উপরে যেমনটি বলা হয়েছে-আবুজর রা.-এর অর্থনৈতিক চিন্তাধারা শিক্ষিত মুসলমান সমাজে শক্তিশালী মিথের অতিরিক্ত বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত-মতামত আকারে হাজির নেই আজও। এটা ইসলামের ইতিহাস নথিবদ্ধ হওয়ার ঐতিহ্যে একটা দুর্বলতা হয়ে আছে। বাস্তবে ইসলামের প্রাথমিক সময় নিয়ে লিখিত ঐতিহাসিক বয়ানগুলোতে অর্থনীতির কথা বিস্ময়কর রকমে কম। এটা প্রাথমিক ইসলাম বিষয়ে বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে এক চ্যালেঞ্জও বটে। যা, ইতিহাসববিদ এম. এ. সাবানের ভাষায়, অনেকটা আজকের দিনে তেল-অর্থনীতি আলাপ না করে মধ্যপ্রাচ্যকে বুঝতে চাওয়ার মতো দুরূহ অবস্থা তৈরি করে। আরব জনপদের দু’দিকে পারস্য ও বাইজেনটাইন-দুটি বিশাল সা¤্রাজ্য ছিল। তারপরও ইসলাম কীভাবে দ্রæত নিজের জায়গা করে নিতে পারল এবং তার পেছনে কী ধরনের রাজনৈতিক-অর্থনীতি কাজ করেছে সেটা আজও কমই খতিয়ে দেখা হয়েছে। এসব সীমাবদ্ধতা সত্তে¡ও এ বিষয়ক আলোচনা এগিয়ে নেওয়া দরকার। ইসলামের ভেতর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ার চিন্তা কীভাবে বিকশিত হয়েছে এবং তা কীভাবে তার রাজনৈতিক গতিপথের সঙ্গে সম্পর্কিত সেটা বোঝা একালে নতুন করে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এ প্রশ্ন আলোচনার ভেতর দিয়ে বর্তমান বৈশ্বিক রাজনৈতিক-অর্থনীতিতে ইসলামের অংশগ্রহণের ঐতিহাসিক ধরন সম্পর্কে আমরা বাস্তবসম্মত কিছু অনুমান করতে পারব। অর্থনৈতিক নীতি-আদর্শের বিকাশ সামাজিক বাস্তবতা এবং শ্রেণিস্বার্থের সঙ্গে সমন্বিত হয়ে কীভাবে এগোয় এবং সেটা আবার কীভাবে রাজনীতি ও সমাজ চিন্তাকে প্রভাবিত করে তাও বোঝা যাবে এরকম অনুসন্ধানের ভেতর দিয়ে। অর্থাৎ প্রাথমিক ইসলামের অর্থনৈতিক উদ্যোগ ও বিতর্কের এরকম পর্যালোচনা থেকে এ কালের সমাজের অর্থনৈতিক চিন্তা ও অনুশীলনের জন্য কোনো উপাদান পাওয়া যায় কি না সেও পরোক্ষে খতিয়ে দেখা সম্ভব।
আলতাফ পারভেজ সাংবাদিক ও গবেষক হিসেবে পরিচিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনশাস্ত্রে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন এবং সামরিক জান্তা বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয়তার কারণে ডাকসুতে সদস্য নির্বাচিত হন। সাংবাদিকতা জীবনে প্রথম থেকে ‘কাউন্টার রিপোর্ট’ ধারণার চর্চা শুরু করেন এবং ১৯৯০ পরবর্তী শাসনামলে আনসার বিদ্রোহ ও কারা বিদ্রোহ নিয়ে সাড়া জাগানো কাজ করেছেন। প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা ১০- এর অধিক । ২০১৫ সালে তাঁর সর্বশেষ প্রকাশিত গ্রন্থ ‘মুজিব বাহিনী থেকে গণবাহিনী’ ইতিহাসের পুনর্পাঠ বাংলাদেশের রাজনৈতিক সাহিত্যে সবচেয়ে আলোচিত একটি গবেষণা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বর্তমানে প্রধানত দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস ও রাজনীতি তাঁর আগ্রহের বিষয়।