আমাদের বর্তমান স্বাধীনতা অতীতের অনেক আন্দোলন-সংগ্রামের সমষ্টিগত ফল। এ কারণে অতীতের সব আন্দোলন-সংগ্রামের তাত্পর্য, ঘটনার পরম্পরা আমাদের বুঝতে হবে। আবুল মনসুর আহমদের এই বই বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম এবং তার বিভিন্ন স্তরের মর্মার্থ উপলব্ধি করতে বিশেষ সহায়ক হবে। শেরে বাংলার উত্থাপিত লাহোর প্রস্তাবের পেছনে বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কী আকাঙ্ক্ষা বা মনস্তত্ত্ব কাজ করেছিল, ভারতভাগের ফলে বাঙালিকে কতটা ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছিল; তারপর পাকিস্তান আমলে যে শোষণ, বৈষম্য, শাসকদের বৈরী মনোভাব ও শেষে ব্যাপক গণহত্যা ঘটেছিল, তার পেছনের মনস্তত্ত্বই-বা কী—এসব বোঝাটাও আমাদের জন্য জরুরি। তারও আগের সিপাহি বিপ্লব, স্বরাজ-খিলাফত বা কৃষক-প্রজা আন্দোলন—এই সব ঘটনাকেই ইতিহাসের উত্তরাধিকার বলে মনে করেন লেখক। ইতিহাসের মধ্যে দ্বান্দ্বিকতা আছে। আছে ধারাবাহিকতা। শেরে বাংলা থেকে বঙ্গবন্ধুর সময় পর্যন্ত রাজনীতির ক্রমবিকাশ বোঝা যাবে এই বই পড়লে। সিপাহি বিপ্লব থেকে দেশভাগ। তারপর বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। এই ঐতিহাসিক অভিযাত্রার বিভিন্ন স্তরের মর্মার্থ উপলব্ধি করতে অবশ্যপাঠ্য এ বই। পাঠক জানতে পারবেন শেরে বাংলা থেকে বঙ্গবন্ধুর সময় পর্যন্ত রাজনীতির ক্রমবিকাশ।
বিশিষ্ট লেখক, দেশভাগের সময়কালের খ্যাতিমান রাজনীতিবিদ এবং শক্তিমান সাংবাদিক আবুল মনসুর আহমদ ছিলেন বিচিত্র গুণের অধিকারী একজন মানুষ। আবুল মনসুর আহমদ এর বই সমূহ বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। তিনি বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ ব্যঙ্গাত্মক লেখকদেরও একজন। ‘আয়না’, ‘ফুড কনফারেন্স’, ‘গালিভারের সফরনামা’র মতো কালজয়ী ব্যঙ্গরচনাগুলো আবুল মনসুর আহমদ রচনাবলীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ বইটি হলো তার সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং প্রশংসিত বই। ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত এ বইটি তার আত্মজীবনীমূলক রচনা। এছাড়াও ‘আত্মকথা’, ‘শেরে বাংলা হইতে বঙ্গবন্ধু’- বইগুলোও স্মৃতিচারণমূলক। আবুল মনসুর আহমদ এর বই সমগ্রতে আরো আছে ‘সত্য মিথ্যা’, ‘জীবনক্ষুধা’, ‘আবে হায়াত’, ‘বাংলাদেশের কালচার’, ‘আসমানী পর্দা’, ‘বেশি দামে কেনা কম দামে বেচা আমাদের স্বাধীনতা’ ইত্যাদি। আবুল মনসুর আহমদের জন্ম ১৮৯৮ সালে ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার ধানীখোলা গ্রামে। ১৯১৯ সালে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করার পর কলকাতার রিপন কলেজে ভর্তি হন আইন পড়বার জন্য। পড়ালেখা করার সময় খিলাফত এবং অসহযোগ আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন তিনি। শিক্ষাজীবন শেষে ৯ বছর ময়মনসিংহে আইন ব্যবসা করেন। এরপর কলকাতায় গিয়ে সাংবাদিক জীবনের সূচনা করেন। ইত্তেহাদ, সুলতান, নাভায়ু, মোহাম্মদী, নবযুগসহ বেশ কিছু পত্রিকায় কাজ করেন তিনি। দেশভাগের কিছুকাল পূর্বেই ইত্তেহাদের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এ দায়িত্বে থেকে তিনি মহান ভাষা আন্দোলনেও ভূমিকা পালন করেছেন। রাজনৈতিক জীবনে আবুল মনসুর আহমদ নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর অনুসারী ছিলেন। ১৯৪০ এর দশকে সক্রিয়ভাবে পাকিস্তান আন্দোলনে যোগ দেন। তিনি ১৯৫৪ এর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন এবং যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রীসভায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিযুক্ত হন। পরবর্তীতে শিক্ষামন্ত্রী এবং বাণিজ্যমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেন। আইয়ুব সরকারের আমলে তিনি তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য কারারুদ্ধ হন। বাংলাদেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক সংগঠন আওয়ামী লীগের অন্যতম এক প্রতিষ্ঠাতা তিনি।