এই গ্রন্থটি প্রকাশের মধ্য দিয়ে ধ্যানবিন্দু পরিবেশচর্চা গ্রন্থমালার সূচনা হল। বিজ্ঞানের নানা শাখার সমন্বয়ে পরিবেশবিজ্ঞান– যার চর্চা আজ আর শুধু বিদ্যায়তনিক পাঠ্যক্রমে আবদ্ধ নেই। প্রকৃতির সঙ্গে প্রযুক্তির সম্পর্ক এমন এক সংঘাতময় পর্যায়ে পৌঁছেছে যে পরিবেশরক্ষা আন্দোলন পৃথিবী জুড়ে মানুষের অধিকার রক্ষার আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। এই বইয়ের লেখক দেবল দেব সম্পর্কে লিখতে গিয়ে বন্ধু স্বর্ণেন্দু সরকার লিখেছেন “মন, মস্তিষ্ক ও মাঠ — এই তিন ভূমির কৃষক দেবল দেব”। বস্তুতই ডক্টর দেবের জীবন তত্ত্ব-কর্ম-ঐক্যের এক জলজ্যান্ত উদাহরণ। আপনারা অনেকে জানেন উন্নয়নের অর্থনীতি ও রাজনীতি বিষয়ক ২০০৯ সালে প্রকাশিত তাঁর বই Beyond Developmentality সুস্থায়ী উন্নয়নের এমন এক মডেল গোটা বিশ্বকে উপহার দিয়েছে যার কেন্দ্রে রয়েছে জীব-বৈচিত্র এবং মানবাধিকারের সংরক্ষণ। অনেকেরই মনে থাকবে তাঁর লেখা ২০০০ সালে প্রকাশিত বই ‘লুঠ হয়ে যায় স্বদেশভূমি’-র কথা। জিন্ প্রযুক্তিসঞ্জাত শস্যের অপবিজ্ঞান, রাজনীতি ও জনস্বাস্থ্যহানির আলোচনায় ভারতীয় ভাষায় প্রথম প্রকাশিত এই বই আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে চেয়েছিল এতে কীভাবে আসলে ধ্বংস হয়ে যাবে প্রাকৃতিক ভারসাম্য। আমরা দেখিনি। যত দিন গেছে তাঁর ভবিষ্যৎবাণীগুলি একে একে কঠোর সত্যে পরিণত হয়েছে। আজ খাদ্যে বিষ পানীয়ে বিষ নিশ্বাসে বিষ, সভ্যতার বর্জ্যে নদী আর নর্দমায় ফারাক লুপ্ত। কিন্তু দেবল দেব থেমে যান নি। জীব-বৈচিত্র এবং মানবাধিকারের সংরক্ষণকে কেন্দ্রে রেখেই যে সুস্থায়ীভাবে ভালো থাকা সম্ভব তার বৈজ্ঞানিক অর্থনৈতিক এবং সামাজিক যুক্তি-পরম্পরাগুলিকে বাস্তব প্রয়োগের ভিত্তিতে সারাজীবন ধরে পরখ করে দেখেছেন ও দেখিয়েছেন তাঁর বহুমুখী বিজ্ঞানসাধনায়। তাঁর বৈজ্ঞানিক সত্তা আর আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক সত্তাকে আলাদা করা মুশকিল। তাই তাঁর গবেষণাকর্মের পরিধির মধ্যে চলে আসে ভারতের খাদ্যসংস্কৃতি ও খাদ্যসুরক্ষা ব্যবস্থা, এবং সেই ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে জংলী অকৃষিজ খাবারের ভূমিকা ও পুষ্টিগুণ। তাঁর চোখে পড়ে ধানের মূল প্রজাতি থেকে ভিন্ন ভিন্ন নানান জাতের স্বাদ ও গন্ধযুক্ত ধানের সৃষ্টি ও তার পিছনে হাজার হাজার বছর ধরে নাম না জানা কত কৃষকের অনুসন্ধিৎসা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার ইতিহাস। ড. দেবের ভাষায়– এঁরাই হলেন আদিম কৃষিবিজ্ঞানী। স্বভাবতই আমাদের দীর্ঘ ঐতিহ্যবাহী চাষবাসের পদ্ধতি ও সময়ের পথ বেয়ে তার পরিবর্তনের ইতিহাস সারাজীবন ধরে তাঁর গবেষণার এক প্রধাণতম বিষয় হয়ে ওঠে। একজন গর্বিত কৃষক হিসেবেই তিনি সংরক্ষণ করেন হারিয়ে যাওয়া নানা জাতের ধানের বীজ। ল্যাবরেটরিতে শুধু নয় মাঠেও। কৃষকদের বিতরণ করেন সেইসব বীজ যাতে দেশের মাটি থেকে তারা নিশ্চিহ্ন হতে না পারে। জেনেটিকালি মডিফায়েড বীজ এবং রাসায়নিক বিষ নির্ভর কৃষিব্যবস্থার বিরুদ্ধে তাঁর এই দীর্ঘমেয়াদি জেহাদ আজ দেশ-বিদেশের বহু মানুষের কাজের অনুপ্রেরণা। জীববৈচিত্র ও তার সংরক্ষণের সূত্র ধরে বনজঙ্গলের বাস্তুসংস্থান ও তার ব্যবস্থাপনাগত প্রকৌশল নিয়ে তাঁর খোঁজ গিয়ে পৌঁছায় দুই বাংলার ‘পবিত্র বন’ (থানের জঙ্গল) ও পবিত্র জলাশয় (ঠাকুরপুকুর) নিয়ে দিকনির্দেশকারী গবেষণায়। তাঁর চোখে ধরা পড়ে ধর্মবিশ্বাসের আঙ্গিকে কীভাবে প্রাচীনকাল থেকে মানুষ সংরক্ষণের বিজ্ঞানকে প্রযুক্ত করেছে সমাজ জীবনে। গাছকাটা ও প্রাণীহত্যা ধর্মীয় কারণে নিষিদ্ধ বলে আজও এইসব ‘পবিত্র’ স্থানে কত লুপ্তপ্রায় উদ্ভিদ ও প্রাণীকুল টিকে আছে। জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হলে ও বাস্তুসংস্থান ভেঙে পড়লে মানুষের অস্তিত্বও যে নিরাপদ নয় এই পরম্পরাগত প্রাচীন জ্ঞানকে প্রকৃতিবিজ্ঞানীর দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করেছেন তিনি। পাগলের মত ছুটে গেছেন কোনো বিলুপ্ত গাছের শেষ নমুনাটিকে বাঁচাতে। সংরক্ষণ করবার জন্য প্রাণপাত করেছেন কোনো পানীয় জলের পুকুরের অনুজৈবিক ভারসাম্যের। সংস্কারের নামে সেই ভারসাম্যকে নষ্ট করে দিলে জলের ঔষধিগুণ যে নষ্ট হয়ে যাবে গ্রামবাসীদের সে ব্যাপারে সচেতন করবার চেষ্টা করেছেন। হয়তো সফল হয়নি তাঁর প্রচেষ্টা সবসময়। কিন্তু তিনি থামেননি। তাঁর সুদীর্ঘ গবেষণা, অনুসন্ধান এবং সংরক্ষণকর্মের ফসল এই বই। বসুধা ট্রাস্ট তাঁর নিজের হাতে তৈরি খামার ও গবেষণাকেন্দ্র, যার সঙ্গে হাত মিলিয়ে এই বইয়ের গ্রন্থপরিকল্পনা ও রূপায়ণের দায়িত্ব পালন করেছে ধ্যানবিন্দু । এ আমাদের গর্বের ব্যাপার।