শুকরিয়া মহান রবের প্রতি যিনি আমাদেরকে সৃষ্টির সাথে সাথে পথপ্রদর্শক হিসেবে তাঁর পক্ষ থেকে প্রতিনিধি নিয়োগ করেছেন। লাখো কোটি দুরূদ ও সালাম রহমাতাল্লিল আলামিন সাইয়্যেদুল মুরসালিন রাসুলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লামের প্রতি! বিনম্র সালাম জামানার ইমাম আল মাহ্দি (আ.)-এর প্রতি যিনি আজও জমিনে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের একত্ববাদের পতাকাকে প্রতিষ্ঠিত করার আমরন সংগ্রামকে জারি রেখেছেন। আল্লাহ তাঁর আত্মপ্রকাশকে তরান্বিত করুন! আমিন! যে ক্ষুদ্র পুস্তিকাটি আপনাদের সম্মানে প্রকাশ করা হয়েছে তা নিছক কোন পুস্তিকা নয়! একগুচ্ছ আলোর মহাবাণী বললেও কম বলা হয়ে যাবে! এই পুস্তিকা সম্পর্কে বলতে হলে, এক কথায় তা —হেদায়াতের অফুরন্ত উৎস! বিস্তারিত আলোচনায় যাওয়ার পূর্বে এই খুতবার প্রেক্ষাপট সংক্ষেপে বলা জরুরি! রাসূল (সা.)-এর ওফাতের পর মদিনায় ঘটে যায় অস্বাভাবিক ঘটনা, যার আকস্মিকতা মুসলমানদেরকে হতবিহ্বল করে দিয়েছিলো! বিদায় হজ্ব থেকে ফেরার পথে আল ‘গাদির’ নামক স্থানে রিসালাতের উত্তরাধিকার ঘোষনা করে আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেছিলেন— “আমি যার মওলা (নেতা), এই আলী তার মওলা (নেতা)!” এই ঐশী ও ঐতিহাসিক ঘোষনা দেখেছিলেন সোয়া লক্ষ হাজী সাহাবি যারা রাসূল (সা.)-এর সাথে বিদায় হজ্বে অংশ নিয়েছিলেন! কিন্তু রাসূল (সা.)-এর তিরোধানের পর যা ঘটলো, তার বিষয়ে সাধারন মুসলমানের মধ্যে শুরু হয়ে গিয়েছিলো দ্বিধা, সংশয়! সাক্বিফার গুহায় একদল র্দূবৃত্তের গোপন বৈঠকে খেলাফতের অবৈধ যাত্রা শুরু হওয়ার পর মদিনার পুরো মুসলিম বিশ্বে ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি হয়! যার প্রমান মিলে রাসূল (সা.)-এর জানাজার মধ্যেই! তিনদিন অবহেলিত অবস্থায় থেকে মাত্র ১৭ জনের উপস্থিতিতে জানাজা ও দাফন সম্পন্ন হয় রাসূল (সা.)-এর! যা কোন ভাবেই যুক্তি ও আক্বলের মাপকাঠিতে ফেলে মূল্যায়ন সম্ভবপর নয়! খেলাফতের আসনে প্রথম খলিফা অধিষ্ঠিত হওয়ার পর একেরপর এক আন্যায় নির্দেশ জারি করেছিলো, যা ছিলো শরিয়তের সরাসরি লংঘন! রাসূল (সা.)-এর হাদিস বর্ননা ও সংরক্ষণ নিষিদ্ধ করা, মা ফাতিমা (সা.আ.)-এর উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া ফাদাকের বাগান বাজেয়াপ্ত করা থেকে শুরু করে এমন সকল নির্দেশ জারি করা হয়েছিলো, যাতে মদিনা সহ সমগ্র মুসলিম বিশ্বে ভীতির পরিবেশ তৈরি হয়! হয়েছিলোও তাই! পরিবেশ পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গিয়েছিলো যে, গাদিরের ঘোষনা সম্পর্কে মানুষ সম্পূর্ন চেপে যেতে বাধ্য হয়! পরিস্থিতি দেখে মা ফাতিমা (সা.আ.) মদিনায় সাহাবিদের ঘরে ঘরে গিয়ে গাদিরে খুমের ঘোষনা সম্পর্কে মুসলমানদের সতর্ক করলেও কেউ কর্নপাত করার সাহস দেখায়নি, কারন সকল ঘরের বাহিরে অবৈধ খেলাফতের সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা পাহারা বলবৎ ছিলো!! সবকিছু থেকে বিমুখ হয়ে রাসূল (সা.)-এর আহলে বাইত যখন গৃহে অবস্থান নেন, তখন খবর আসে রাসূল (সা.)-র উত্তরাধিকার থেকে প্রাপ্ত ফাদাকের বাগান বাজেয়াপ্তের! এই খবরে মা ফাতিমা (সা.আ.) নিজ গৃহ থেকে বেরিয়ে এসে মদিনার বাজার ঘুরে মসজিদে নববীতে এসে উপস্থিত হলেন, যেখানে প্রায় সকল সাহাবি উপস্থিত ছিলেন। হাদিস থেকে শুরু করে তারিখের কিতাবগুলোতে এই ঘটনাকে ‘মিরাস’ বন্টনের ঝগড়া হিসেবে দেখানো হলেও, মোটেও বিষয়টি তেমন ছিলো না! বিষয়টি ছিলো পুরোপুরি রাজনৈতিক এবং মুসলিম উম্মাহর হেদায়াত সম্পর্কিত! খলিফা আবু বকরের মসনদের সম্মুখে মা ফাতিমা (সা.আ.)-এর বক্তব্যের প্রতিটি শব্দ ছিলো মুসলিম উম্মাহর জন্য হেদায়াতের নির্দেশিকা, যা মিরাসের ঘটনা হিসাবে দেখিয়ে ম্লান করার হীনচেষ্টা করেছিলো অবৈধ খেলাফতের ধজ্বাধারিরা! মা ফাতিমা (সা.আ.)-এর ব্যক্তিত্ব, জীবন যাপন বিশ্লেষন করলে এটা সহজেই অনুমেয় যে, সামান্য খেজুর বাগানের অধিকারের দাবিতে তিনি কথা বলতে পারেন না! এমনটা তাঁর সাথে সম্পূর্ন বেমানান! যিনি জান্নাতের নেত্রী তিনি এতো সামান্য বিষয়ে কারো সাথে বাদানুবাদ করবেন, সেটা মোটেও যৌক্তিক না! তাহলে ঘটনা কি? ঘটনা হচ্ছে, তিনি সেদিন উপস্থিত মুসলমানদের পথভ্রষ্টতা থেকে ফিরে আসার জন্য সতর্ক করেছিলেন আল-কোরআন এবং নবী (সা.)-এর সুন্নাহ থেকে সূত্র উল্লেখ করে! সুস্পষ্ট করে তিনি সেদিন রিসালাতের লক্ষ্য উদ্দেশ্য পরিষ্কার করে দিয়েছিলেন এবং সেই মোতাবেক মুসলমানের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে অবহিত করেছিলেন! তাঁর সেদিনের খুতবা এতোটাই ধারালো ছিলো যে, তাঁর বক্তব্যকে বন্ধ করার জন্য তৎকালিন খলিফা ফাদাকের বাগান লিখে দেয়ার জন্য উদ্যত হলেও হযরত উমরের হস্তক্ষেপে তা রহিত করতে হয়েছিলো! মা ফাতিমা (সা.আ.)-এর যৌক্তিক ও সূত্র ভিত্তিক কঠোর বক্তব্যটি অবৈধ খেলাফতের ধারক-বাহকদের সারা দেহে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলো, যার স্ফুলিঙের ছোঁয়ায় ভষ্ম হয়ে যায় নবী নন্দিনির আবাসস্থল! কথায় আছে, ইতিহাস ক্ষমতাসিনদের হাতেই রচিত হয়, যার প্রমান আমরা পাচ্ছি ১৪০০ বছর ধরে! এতো নির্মম ঘটনা ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছে শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে! জুলুমের কাঠগড়ায় ঐতিহাসিক সত্যের কন্ঠ চেপে ধরা হয়েছে! কিন্তু তবুও রোধ করা যায়নি বা আড়াল করা যায়নি! কেননা, আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের ওয়াদা হচ্ছে— “তিনি তাঁর নূরকে প্রজ্বলিত রাখবেনই, তা কাফেরদের যতোই অসহ্য লাগুক না কেন!” সিদ্দিকাতুল কুবরা, জান্নাত নেত্রী হযরত ফাতিমা বিনতে রাসূলুল্লাহ্ (দ.) যত দিন এ ধরণীতে ছিলেন হযরত আবু বকর (রা.) ও হযরত ওমর (রা.)-এর প্রতি ক্রোধান্বিত ছিলেন এবং মৃত্যুর পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত তাদের সঙ্গে কথা বলেননি, এমনকি তাদের সালামের উত্তর-ও দেন নি। [(ক) সহীহ্ আল বোখারী, (ইসলামিক ফাউন্ডেশন), ৫ম খণ্ড, হাদিস নং-২৮৬৬/৪র্থ সংস্করণ জুন’০৫, পৃ-২৮৪ থেকে ২৮৯, হাদিস নং-২৮৭৪ ও ২৮৭৫ এবং ৬ষ্ঠ খণ্ড, ৩৪৩৭/৪র্থ সংস্করণ মার্চ’০৬, পৃ-৩০৮ থেকে ৩০৯, হাদিস নং-৩৪৪৬ ও ৩৪৪৮; সহীহ আল বুখারী, (তাওহিদ পাবলিকেশন্স), অধ্যায়-৫৭, খুমস (এক পঞ্চমাংশ), হাদিস নং-৩০৯৩; সহীহ আল বুখারী (আধুনিক প্রকাশনী), ৩য় খণ্ড, হাদিস নং- ২৮৬০ ও ২৮৬১ এবং ৩৪৩৬; ৩৩৩৮ এবং ৩৪৮৪; ৪র্থ খণ্ড, হাদিস নং-৩৭৩৩ ও ৩৭৩৪; ৬ষ্ঠ খণ্ড, হাদিস নং-৬২৫৮, প্রকাশকাল-১৯৯৯, অনুবাদে- মাওলানা আফলাতুন কায়সার (ফাযেলে দেওবান্দ), অধ্যাপক মোজাম্মেল হক (এম. এম. এম. এ), মুহাম্মদ মুসা (এম. এম. এম. কম), অধ্যাপক এ. এম. মো: মোসলেম (এম. এম. এম. এ), সায়ীদ আহমেদ (এম. এম.), মাওলানা সাফাতুল্লাহ (এম. এম. বি. এ.); (খ) সহীহ্ মুসলিম শরিফ, (ইসলামিক ফাউন্ডেশন), ৫ম খণ্ড, হাদীস নং-৪৪২৮; সহীহ মুসলিম, (হাদীস একাডেমি), অধ্যায়-৩৩, (জিহাদ ও সফর), হাদিস নং-৪৪৭২, ৪৪৭৭; সহীহ মুসলিম, (বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার), হাদিস নং-৪৪৩১, ৪৪৩২।] কালের বিবর্তনে এই ঐতিহাসিক ঘটনা ঘুরে ঘুরে পৃথিবীর প্রতিটি জমিনেই পৌঁছেছে এবং মানুষের হাতে হাতে তুলে দেয়া হয়েছে! আমাদের এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা কেবলমাত্র মুসলমানদেরকে সতর্ক করার উদ্দেশ্যে, যাতে মানুষ হেদায়াতের পথ খুঁজে পেতে পারে! এই ক্ষুদ্র পুস্তিকাটি মা ফাতিমা (সা.আ.)-এর ঐতিহাসিক ভূমিকারই ধারাবাহিকতা, যা আমাদের পরেও চলমান থাকবে! পাঠকদের কাছে আমাদের অনুরোধ থাকবে নিজের আকলের দুয়ার খোলা রেখে পড়ুন! নিঃসন্দেহে হেদায়াত আল্লাহর পক্ষ থেকেই আসে!
Title
মসজিদে নববীতে জান্নাত নেত্রী মা ফাতিমা (সা.আ.)-এর ঐতিহাসিক বক্তৃতা