"আমার জীবনানন্দ আবিষ্কার ও অন্যান্য" বইয়ের ফ্ল্যাপের লেখা: যে-কোনও ধরনের গদ্যরচনায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় পাঠককে মায়ামুগ্ধ করে রাখতে পারেন। তাঁর উপন্যাস ও গল্পের আশ্চর্য নির্মিতি সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার নেই। বিপুল পরিমাণ কথাসাহিত্য ছাড়াও তিনি এ যাবৎ যেসব অজস্র প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছেন, সেগুলিও এক-একটি আশ্চর্য সৃষ্টি। বিভিন্ন সময়ে লেখা, বিভিন্ন বিষয়ের সেইসব রচনা নামী-অনামী পত্র-পত্রিকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। অগ্রন্থিত এইসব লেখা থেকে বাছাই করে বত্রিশটি ছােট-বড় রচনা সংকলিত হয়েছে এই গ্রন্থে। রচনাগুলি মূলত বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত কিংবা বিস্মৃত স্রষ্টা ও তাঁদের সৃষ্টি সম্পর্কে লেখকের ব্যক্তিগত অনুভূতির বাণীরূপ। অন্তরঙ্গ স্মৃতির ছোঁয়ায় প্রতিটি রচনা প্রাণবন্ত। স্বচ্ছন্দ অনায়াস গদ্যের নিবিড় স্পর্শে আদ্যন্ত সুখপাঠ্য। একই সঙ্গে আবার বহু অজানা স্মৃতিরঙ্গের ঝলকে উদ্ভাসিত। জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, সতীনাথ ভাদুড়ী, কমলকুমার মজুমদার, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিভূতিভূষণ । বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সৈয়দ মুজতবা আলী, শিবরাম চক্রবর্তী, মহেন্দ্রনাথ দত্ত, জ্যোতিরিন্দ্র। নন্দী, কাজী নজরুল ইসলাম, জগদীশ গুপ্ত, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, আবু সয়ীদ আইয়ুব প্রমুখ আরও অনেকের প্রতি লেখকের শ্রদ্ধা, সম্মান, প্রীতি, ভাললাগা এবং ভালবাসার অকৃত্রিম আত্মকথন ধরা রইল এই ভিন্নস্বাদের গ্রন্থে।
বিশ শতকের শেষাংশে জন্ম নেওয়া সব্যসাচী একজন বাঙ্গালি সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, সম্পাদক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট- এমন বহু পরিচয়ে সাহিত্যের অগণিত ক্ষেত্রে তিনি রেখেছেন তাঁর সুকুমার ছাপ। নীললোহিত, সনাতন পাঠক কিংবা কখনো নীল উপাধ্যায় ছদ্মনামে প্রকাশিত হয়েছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর বই সমূহ। অধুনা বাংলাদেশের মাদারীপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন ৭ সেপ্টেম্বর ১৯৩৪। কিন্তু মাত্র চার বছর বয়সেই স্কুল শিক্ষক বাবার হাত ধরে সপরিবারে পাড়ি দিয়েছিলেন কলকাতায়। ১৯৫৩ সালে সাহিত্যে বিচরণ শুরু হয় কৃত্তিবাস নামের কাব্যপত্রিকার সম্পাদনার মধ্য দিয়ে। ১৯৫৮ সালে প্রকাশ পায় প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘একা এবং কয়েকজন’। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর বই মানেই পাঠকের কাছে আধুনিকতা আর রোমান্টিকতার মেলবন্ধন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কবিতার বই হলো ‘আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি’, ‘যুগলবন্দী’ (শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে), ‘হঠাৎ নীরার জন্য’, ‘রাত্রির রঁদেভূ’ ইত্যাদি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বই সমগ্র ‘পূর্ব-পশ্চিম’, ‘সেইসময়’ এবং ‘প্রথম আলো’ তাঁকে এপার, ওপার আর সারাবিশ্বের বাঙালির কাছে করেছে স্মরণীয়। ‘কাকাবাবু-সন্তু’ জুটির গোয়েন্দা সিরিজ শিশুসাহিত্যে তাকে এনে দিয়েছিলো অনন্য পাঠকপ্রিয়তা। তাঁরই উপন্যাস অবলম্বনে কিংবদন্তী পরিচালক সত্যজিৎ রায় পরিচালনা করেছিলেন ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ এবং ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’র মতো চলচ্চিত্র। পাঠক সমাদৃত ভ্রমণকাহিনী ‘ছবির দেশে কবিতার দেশে’ কিংবা আত্মজীবনীমূলক ‘অর্ধেক জীবন বই’তে সাহিত্যগুণে তুলে ধরেছিলেন নিজেরই জীবনের গল্প। ২০১২ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চার দশকে তিনি পরিচিত ছিলেন জীবনানন্দ পরবর্তী পর্যায়ের অন্যতম প্রধান কবি এবং বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসেবে।