ভূমিকা ঝজুদা কাহিনিগুলি শুধুমাত্র কিশোর পাঠ্য নয়, বাড়ির সকলেরই সমান ভাললাগার।
‘ঝজুদা সমগ্র’র পঞ্চ খণ্ডে পাঁচটি ঝজুদা কাহিনি সংকলিত হল। এর মধ্যে, ‘ফাগুয়ারা ভিলা’ গোয়েন্দা কাহিনি। তোমরা এবং তোমাদের বাড়ির অন্যরা যাঁরা ‘ঝজুদা সমগ্র’র আগের চারটি খণ্ড পড়েছ তারা জানো যে ‘অ্যালবিনো’, ‘রুআহা’, ‘ঝজুদার সঙ্গে সেশ্যেলস আইল্যান্ডে’ এবং ‘কাঙ্গপোকপি’র মধ্যে ‘রুআহা’ পূর্ব আফ্রিকার রুআহা ন্যাশনাল পার্ক ও রুআহা নদীর উপত্যকায় বিশ্বাসঘাতক ভুষুণ্ডাকে শিক্ষা দেওয়ার কাহিনি, ‘ঝজুদার সঙ্গে সেশ্যেলস আইল্যান্ডে’ জলদস্যুদের দুই পরিবারের মধ্যে লুকিয়ে রাখা গুপ্তধন নিয়ে বিবাদের প্রেক্ষিতে লেখা, ‘কাঙ্গপোকপি’ মণিপুর আর বার্মার (এখন যার নাম মিয়ানমার) পটভূমিতে একটি মস্ত বড় হিরে চুরির রহস্যভেদের গল্প।
এই অবসরে বলে ফেলি যে, কোনও ঝজুদা কাহিনির পটভূমিই কল্পিত নয়। পূর্ব আফ্রিকা থেকে ভারত মহাসাগরের সেশ্যেলস আইল্যান্ডস, বা মণিপুর মিয়ানমার বা আন্দামান আইল্যান্ডস, বা ভারতের নানা প্রান্তের সব বনভূমিতে আমি নিজে ঘুরে আসার পরই ঝজুদা কাহিনি লিখতে বসেছি তোমাদের জন্যে। তাই এগুলি শুধুমাত্র গোয়েন্দা বা শিকার কাহিনি নয়, এগুলি পড়লেও বাড়ি সুদ্ধ সকলের নতুন নতুন নানা জায়গাতে বেড়িয়ে আসার সুযোগ হবে এই সব লেখার মাধ্যমে। নিজে সশরীরে গেছি প্রতিটি জায়গাতেই। ওই সব জায়গা, মানুষজন এবং আরও নানা বিষয়ে ফিরে এসে অনেক পড়াশুনাও করতে হয়েছে যে তা বই পড়লেই তোমরা বুঝবে।
এই খণ্ডে ‘ফাগুয়ারা ভিলা’ ছাড়া অন্যান্য যে কাহিনিগুলি আছে তাদের একটি ‘ঝজুদার সঙ্গে আন্ধারী তাড়োবাতে’। আন্ধারী-তাড়োবা টাইগার রিসার্চ মহারাষ্ট্রের একটি অত্যন্ত পুরনো পার্ক। এখন অবশ্য ছত্তিশগড়ের অন্তর্ভুক্ত। এখানে একবরমের গাছ দেখতে পাওয়া যায় তাদের নাম ভূত গাছ- Ghost Tree বা Karu Gum Tree। এমন রহস্যময়ী ভয় পাওয়ানো গাছ পৃথিবীর আর কোনও দেশে আছে কি না জানি না।
যেসব পত্র-পত্রিকার পুজোসংখ্যাতে ওই সব কাহিনিগুলি প্রকাশিত হয়েছিল তাঁদের সম্পাদকদের অনুরোধে অনেকসময়ে ভ্রমণ কাহিনির মধ্যে গাজোয়ারি করে শিকার কাহিনি ঢোকাতে হয়েছে নিজের অনিচ্ছাসত্ত্বেও। শিকার কাহিনি লেকার আর বেশি লেখক নাকি এখন তাঁরা পান না তাই আমার ওপরে এমন জোরজার করেন। ‘কেশকাল-এর বাঘিনী’ ছত্তিশগড়ের কেশকালঘাটির পটভূমিতে লেকা। ‘ছোটিডোঙ্গরির চিতা’ ছত্তিশগড়ের বস্তারের নারায়ণপুর ও অবুঝমার-এর মধ্যবর্তী একটি ছো্ট্ট গ্রাম ছোটিডোঙ্গরির পটভূমিতে লেখা। ‘লিলি সিম্পসন- এর বাঘ’, পালাম্যুর রুদ- এর পটভূমিতে লেখা। এই সব কাহিনির প্রত্যেকটিতেই ঝজুদা এবং তাঁর তিনি সার্গিদ রুদ্র, তিতির এবং ভটকাই আছে।
মহারাষ্ট্রের আন্ধারী-তাড়োবা এবং ছত্তিশগড়ের নানা পাহাড় পর্বত দেখা সম্ভব হত না নাগপুরের প্রদীপ গাঙ্গুলী এবং তাঁর বন্ধুদের উৎসাহ ছাড়া। সব বন্দোবস্ত ওঁরাই করেছিলেন এবং শুধু বন্দোবস্ত নয়, রাজকীয় বন্দোবস্ত। তাই ঝজুদা কাহিনির এই খণ্ডটি আমি তাঁদের উৎসর্গ করে তৃপ্তি বোধ করেছি। তাঁদের জণ শোধনীয় নয়, তবে স্বীকার অবশ্যই করা যায়। সেই ঋণ শোধার চেষ্টা নয়, স্বীকার করারই উদ্দেশ্যে এই উৎসর্গীকরণ।
ঝজুদা কাহিনি লিখতে আমার সবচেয়ে বেশি ভাল লাগে। তোমরা যারা ঝজুদার কাহিনিগুলি পড়ো তাদের এসব কাহিনি পড়তে ভাল লাগলেই আমি ধন্য হব। তোমাদের প্রত্যেককে আগাশী নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানিয়ে-
বুদ্ধদেব গুহ একজন ভারতীয় বাঙালি ঔপন্যাসিক ও সংগীতশিল্পী। তিনি ১৯৩৬ সালের ২৯ জুন কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। বন, অরণ্য ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখার মাধ্যমে পাঠকহৃদয় জয় করে নেওয়া এই লেখকের জীবন অভিজ্ঞতা ও বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে তিনি পড়াশোনা শেষ করেন। এরপর নিয়মিত লেখালেখি শুরু করেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘জঙ্গলমহল’। রচনাশৈলীর অনন্যতা ও স্বাতন্ত্র্য তাকে বাঙালি পাঠকের অন্যতম প্রিয় লেখকে পরিণত করেছে। বুদ্ধদেব গুহ কবিতা, ছোটগল্প ও উপন্যাস রচনা করেছেন, যা তাকে খ্যাতির চূড়ায় নিয়ে গিয়েছে। তাঁর সৃষ্ট বিখ্যাত চরিত্র ঋজুদা যেন তাঁর মতোই পরিব্রাজক। সে বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায় তার সঙ্গী রুদ্রকে নিয়ে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করে আসা এই লেখক অরণ্যকে যেমন তাঁর লেখার এক মূল আধেয় হিসেবে ধরে নিয়েছেন, তেমনই তাঁর লেখাগুলোর পটভূমিও ছিল পূর্ব বাংলার গহীন অরণ্য। এর সাথে তিনি সমাজের উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জীবনযাপন তাঁর লেখনীতে তুলে ধরেছেন, যা তাকে খুব সহজেই খ্যাতির পাত্রে পরিণত করে। বুদ্ধদেব গুহ প্রেমের উপন্যাস রচনা করেছেন বেশ কয়েকটি। এর মাঝে ‘হলুদ বসন্ত’ অন্যতম। বাংলা কথাসাহিত্যে এমন রোমান্টিসিজমের সংযোজন খুব কম লেখকই করতে পেরেছেন। পাঠকনন্দিত বুদ্ধদেব গুহ এর উপন্যাস সমগ্র হলো ‘মাধুকরী’, ‘একটু উষ্ণতার জন্য’, ‘নগ্ন নির্জন’, ‘অববাহিকা’, ‘পরদেশিয়া’, ‘সবিনয় নিবেদন (পত্রোপন্যাস)’, ‘আলোকঝারি’ ইত্যাদি। ছোটদের জন্য লিখেছেন ‘ঋজুদা’ সিরিজ। তাঁর রচিত ‘মাধুকরী’ উপন্যাস একইসাথে বিতর্কিত ও তুমুল জনপ্রিয়। বুদ্ধদেব গুহ এর বই সমগ্র শুধু উপন্যাস হিসেবে নয়, নগর ও অরণ্যের স্তুতি হিসেবে পাঠকের কাছে ভালোবাসার স্থান পেয়েছে। লেখালেখির পাশাপাশি তিনি একজন চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট এবং একজন নামকরা সঙ্গীতশিল্পীও বটে। বুদ্ধদেব গুহ এর বই সমূহ থেকে নির্মিত হয়েছে একাধিক টিভি অনুষ্ঠান ও চলচ্চিত্র। ১৯৭৭ সালে তিনি আনন্দ পুরস্কার পান। তাঁর রচনার জন্য তিনি বাংলা কথাসাহিত্যে এক মাইলফলক তৈরি করেছেন।