প্রারম্ভিকা এই বিষয়টা সত্যিই বিস্ময়ক; বরং বলা যায়- মানুষ সাগরের তলদেশে গিয়ে নিত্যনতুন বিস্ময় জাগানিয়া চমকপ্রদ সব জিনিস আবিষ্কার করে অনন্য প্রতিভার পরিচয় দিয়েছে। চাঁদের দেশে পদচিহ্ন এঁকে দিয়ে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করেছে। মঙ্গলগ্রহ তার বক্ষে কী ধারণ করে আছে আর শুক্রগ্রহের বুকেই বা কি প্রাকৃতিক সম্পদ গচ্ছিত আছে- সেসব আবিষ্কার করার জন্য চেষ্টা-প্রচেষ্টা ও কষ্ট ক্লেশ; সবকিছুই সমান্তরালে চলছে। চলতেই থাকবে। তবে অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হচ্ছে, উন্নতি ও উৎকর্ষের চূড়ায় আরোহণ করা মানবজাতি আজ পর্যন্ত এ বিষয়টা অনুভব করতে পারেনি যে, অনস্বীকার্য বাস্তবতা অস্বীকার করার দ্বারা দীর্ঘ নাকি স্বীকার ও আনুগত্যের? সভ্যতা ও ভব্যতার ঠিকাদার মানবজাতি কতকিছু অস্বীকার করে বসে আছে। আল্লাহকে অস্বীকার করেছে, তার অসীম কুদরত ও সীমাহীন শক্তি অস্বীকার করেছে, তার নিঃসীম জ্ঞান অস্বীকার করেছে, তিনি যে সবার রিজিকদাতা এবং সৃষ্টিকর্তা-সেটা অস্বীকার করেছে, সপ্তাকাশ, কুদরত, কুরআন মাজিদ- এমনকি নিষ্পাপ ফেরেশতাদের পর্যন্ত ছাড়েনি। পরকালের জীবন, কেয়ামত, জান্নাতের সুখ-শান্তি এবং জাহান্নামের ভয়াবহ শাস্তির অস্বীকারও বাদ পড়েনি। অর্থাৎ তাদের এই অস্বীকৃতিরই ধারা থেকে সৃষ্টি হয়েছে আরও যত অকল্যাণ ও অস্বীকৃতি। এবার অস্বীকৃতির ধারা-উপধারা পার করে গভীরভাবে দেখলে পরিলক্ষিত হবে, তা হিমালয়ের দৈর্ঘ্য-প্রস্তের চেয়েও বেশি দীর্ঘ ও প্রশস্ত। আর তার গভীরতা সমুদ্রের গভীরতার চেয়েও বেশি। কিন্তু তারপরও এতে আশ্চর্যের কিছু আছে বলে আমার মনে হয় না-যদিও কুফরি ও অস্বীকৃতির এই মহামারি পূর্ব থেকে পশ্চিম এবং উত্তর থেকে দক্ষিণ, সমগ্র পৃথিবীতেই ছড়িয়ে পড়ে। যদিও সকল মানুষ প্রজ্জ্বলিত আলোর চেয়েও উজ্জ্বল বাস্তবতাকে অস্বীকার করে বসে। অথচ এই মূর্খ মানবজাতি রসুন, পেঁয়াজ, মরিচ ও হলুদ প্রভৃতির প্রভাব ও প্রতিক্রিয়াকে ঠিকই মেনে নেয়। আঘাত পেলে ব্যথা অনুভব করে। সুসংবাদে তার চেহারা আনন্দোডাসে উদ্ভাসিত হয়। সুন্দর দৃশ্যের ব্যাপারেও সে কখনও অস্বীকৃতি জানায়নি। ঘ্রাণ নেওয়া কিংবা গন্ধের কথাও সে অস্বীকার করেনি। স্বাদ আস্বাদন করেছে খাবারের, তা-ও অস্বীকার করতে পারেনি। কিন্তু সেই মানুষই অস্বীকার করে বসে আছে শাশ্বত সত্যকে। সবকিছুর সত্যতাই স্বীকার করে নিতে পারে। কিন্তু স্বীকার করে নিতে পারেনি কেবল তাবিজ-কবজের প্রভাব ও প্রতিক্রিয়াকে; যার কিছু বিষয় নবুওয়াতের পবিত্র জবান থেকেও নিসৃত হয়েছে। যে জবান থেকে পবিত্র ও বর্ণনায় অধিক সত্য আর কোনো জবান সৃষ্টিজগতে আসেনি। চিকৎসকের ব্যবস্থাপত্র, নির্ধারিত চিকিৎসা, আর নির্দিষ্ট ওষুধ- সবকিছুই নির্ভরযোগ্য। অনির্ভরযোগ্য কেবল আত্মার ব্যাধির চিকিৎসকের মূল্যবান চিকিৎসা। স্বীকৃতি-অস্বীকৃতির এই দো-টানায় সমাধানে না গিয়ে শোরগোল বাড়ানোই কি সঠিক পন্থা? কখনও না! বরং এ ক্ষেত্রে যাচাই-বাছাই করে নেওয়া সিদ্ধান্তটাই সঠিক সিদ্ধান্ত। তাবিজ-কবজ ও অজিফার বিষয়টা আদিকাল থেকে স্বীকৃত। তার প্রভাবও অনস্বীকার্য। যার সাক্ষ্য পাওয়া যায় বুখারি ও মুসলিমের বর্ণনা থেকে- রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অভ্যাস ছিল, আমাদের কেউ অসুস্থ হলে তিনি নিজে রোগীর গায়ে হাত বুলিয়ে এই দুআ পড়তেন- أَذْهِبْ الْبَاسَ رَبَّ النَّاسِ وَاشْفِ أَنْتَ الشَّانِي لَا شِفَائَكَ شِفَاءٌ لَا يُغَادِرُ سَقَمًا. হে আল্লাহ! ব্যথা-কষ্ট দূর করে দিন। রোগীকে পূর্ণ সুস্থতা দিন। আপনার দান করা সুস্থতাই তো সুস্থতা। আপনি এমন সুস্থতা দান করুন- যাতে রোগ-বালাই একেবারে দূরীভূত হয়ে যায়। এই রেওয়ায়েত বর্ণনা করেছেন নবি-পরিবারেরই একজন সদস্য- আম্মাজান আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা; যা থেকে প্রতিভাত হয়- নবি-যুগেরই নিত্যদিনের আমল ছিল এই ঝাঁড়-ফুঁকই- যা আজকের এলিট সমাজ অস্বীকার করে। আবার এই আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকেই হাদিস শাস্ত্রের অবিসংবাদিত দুজন ইমাম বুখারি ও মুসলিম রাহিমাহুমাল্লাহ আরেকটা হাদিস বর্ণনা করেছেন- কেউ অসুস্থ হলে অথবা কারও ফোঁড়া-ফুসকুড়ি হলে নবিজি অসুস্থ ব্যক্তির শরীরে আর ফোঁড়া-ফুসকুড়ির জায়গায় হাত রেখে পড়তেন: سَقِيمُنَا بِإِذْنِ رَبِّنَا. بِسْمِ اللَّهِ تُرْبَةُ أَرْضِنَا بِرِقَةِ بَعْضِنَا لِيُشْفِى হজরত আবদুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভি রহ. উপরে বর্ণিত হাদিস সম্পর্কে লিখেন- এটা ফোঁড়া-ফুসকুড়ির জন্য আরোগ্যদানকারী আমল ও চিকিৎসা। যা কেবল বোধসম্পন্ন ব্যক্তিদের পক্ষেই উপলব্ধি করা সম্ভব। পারতপক্ষে ঝাড়- ফুঁকের বিস্ময়কর প্রভাব সহজে উপলব্ধি করা যায় না। (আশিয়্যাতুল লামিআত। তাছাড়া তিনি দর্শন ও বিজ্ঞানের রোগে আক্রান্ত বুদ্ধিজীবিদের ঝাঁড়-ফুঁক নিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করতেও নিষেধ করেছেন। কারণ এসব মূলত বিশ্বাসের বিষয়। তাই এসব নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করা তথাকথিত বুদ্ধিজীবিদের জন্য ফলপ্রসূ নয়। যেমন দেখুন-আয়েশা রাদি. থেকে বর্ণিত হাদিসের শেষাংশ হচ্ছে ঘরে কেউ অসুস্থ হলে নবিজি সুরা ফালাক ও সুরা নাস পড়ে ফুঁ দিতেন। শুধু তাই নয়, উসমান ইবনে আবিল আস রাদিয়াল্লাহু আনহুর বর্ণনা উদ্ধৃত করে বুখারি রাহমাতুলাহি আলাইহি শুনিয়েছেন- উসমান ইবনে আবিল আস রাদিয়াল্লাহু আনহু নিজের এক ব্যথাজনিত অসুস্থতার কথা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে ব্যক্ত করেন। তখন তিনি তাকে কোনো ব্যথানাশক দাওয়াই বা অন্যকিছু দেননি। বরং বলেছেন- উসমান, তুমি ব্যথার জায়গায় হাত রেখে তিনবার বিসমিল্লাহ পড়বে। তারপর এই দুআ পড়বে-. অর্থাৎ আমি যেসব রোগ অনুভব করছি, সেসব হতে আল্লাহ তাআলার ইজ্জত এবং কুদরতের আশ্রয় চাই। উসমান রাদিয়ালাহু আনহুর বর্ণনা মোতাবেক ওই দুআ পড়ার পর নিমিষেই ব্যথা চলে যায়। এ আমলের বর্ণনাসমূহে এ কথাও রয়েছে- রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অসুস্থতার সময়ে জিবরাইল আলাইহিস সালাম আল্লাহর পক্ষ থেকে আরোগ্যলাভের ব্যবস্থাপত্র নিয়ে এসেছিলেন। ইমাম মুসলিম রহ.-এর মতে, তার আনীত ব্যবস্থাপত্রে বনফেশা, গাওযেবান বা তখমে খেতমি নয়, বরং মাত উল্লেখিত দুআর আমল ছিল। রইল সাহাবায়ে কেরামের কথা। তারা ভীতিকর রোগ-ব্যধিতে গলায় তাবিজ ধারণ করতেন।