"জয় বাবা ফেলূনাথ" বইয়ের ভিতরের অংশ থেকে নেওয়া: কাশীতে সারাজীবন থাকতে ভাল লাগবে না নিশ্চয়ই, কিন্তু যখনই ভাবছি আট-দশ দিনের বেশি থাকবার দরকার নেই তখনই মন বলছে বেনারসের মতাে জায়গা হয় না। ‘তার কারণটা কী জানিস ?—ফেলুদা বলল—“তুই যে নীচের দিকে তাকিয়ে শুধু একটা রাস্তা দেখছিস তা তাে নয় ; তুই দেখছিস বেনারসের রাস্তা। বেনারস! কাশী ! বারাণসী।—চারিটিখানি কথা নয়। পৃথিবীর প্রাচীনতম শহর, পুণ্যতীর্থ, পীঠস্থান! রামায়ণ মহাভারত মুনিঋষি যােগী সাধক হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ জৈন সব মিলে এই বেনারসের একটা ভেলকি আছে যার ফলে শহরটা নােংরা হয়েও ঐতিহ্যে ঝলমল করতে থাকে। যারা এখানে বসবাস করে তারা দিন গুজরানাের চিন্তায় আর এ সব কথা ভাববার সময় পায় না, কিন্তু যারা কয়েক দিনের জন্য বেড়াতে আসে তারা এইসব ভেবেই মশগুল হয়ে থাকে। লালমােহনবাবু এই ফাঁকে কখন জানি ভিতরে চলে গিয়েছিলেন, হঠাৎ তাঁর গলার আওয়াজ পেয়ে পিছন ফিরে দেখি তিনি সঙ্গে একজন অচেনা লােককে নিয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছেন। বছর পঞ্চাশেক বয়স, মাঝারি রং, মাথার কাঁচাপাকা চুল মাঝখানে সিঁথি করে পিছন দিকে টান করে আঁচড়ানাে। চোখা নাকের নীচে পাতলা পান-খাওয়া ঠোঁট অল্প হাসিতে ফাঁক হয়ে আছে। ভদ্রলােক ফেলুদাকে নমস্কার করে বললেন, আপনার পরিচয় পেলুম এনার কাছ থেকে। আমার হােটেলের সম্মান বাড়ল, হেঃ হেঃ।
সত্যজিৎ রায় এক বাঙালি কিংবদন্তী, যিনি বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রকারের খ্যাতি অর্জন করেছিলেন বিশ্বদরবারে। কর্মজীবনে একইসাথে চিত্রনাট্য রচনা, সঙ্গীত স্বরলিপি রচনা, সম্পাদনা, প্রকাশক, চিত্রকর, গ্রাফিক নকশাবিদ, লেখক ও চলচ্চিত্র সমালোচক হিসেবে ভূমিকা রেখেছেন অসম্ভব গুণী এই মানুষটি। ১৯২১ সালে কলকাতার শিল্প-সাহিত্যচর্চায় খ্যাতনামা এক বাঙালি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদী উপজেলার মসূয়া গ্রামে রয়েছে তাঁর পৈত্রিক ভিটা। ইতালীয় নব্য বাস্তবতাবাদী ছবি ‘লাদ্রি দি বিচিক্লেত্তে’ বা ‘দ্য বাইসাইকেল থিফ’ তাঁকে এতটাই প্রভাবিত করেছিলো যে, সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন চলচ্চিত্র নির্মাণের। প্রথম চলচ্চিত্র ‘পথের পাঁচালী’র জন্যই পেয়েছিলেন ১১টি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, যার মধ্যে অন্যতম হলো কান চলচ্চিত্র উৎসবে পাওয়া ‘শ্রেষ্ঠ মানব দলিল’ পুরস্কার। তবে তাঁর কাজের সমালোচকও কম ছিলো না। এসব সমালোচনার উত্তরে লেখা দুটি প্রবন্ধ পাওয়া যায় সত্যজিৎ রায় এর বই ‘বিষয় চলচ্চিত্র’-তে। কল্পকাহিনী ধারায় সত্যিজিৎ রায় এর বই সমূহ জয় করেছিলো সব বয়সী পাঠকের মন। তাঁর সৃষ্ট তুখোড় চরিত্র ‘ফেলুদা’, ‘ প্রফেসর শঙ্কু’ এবং ‘তাড়িনী খুড়ো’ যেন আজও জীবন্ত। একের পিঠে দুই, আরো বাড়ো এমন মজার সব শিরোনামে বারোটির সংকলনে লিখেছেন অসংখ্য ছোটগল্প। এছাড়াও সত্যজিৎ রায় এর বই সমগ্র’র মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো চলচ্চিত্র বিষয়ক ‘একেই বলে শ্যুটিং’, আত্মজীবনীমূলক ‘যখন ছোট ছিলাম’ এবং ছড়ার বই ‘তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম’। ১৯৯২ সালে মৃত্যুর কিছুদিন আগেই তার বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘একাডেমি সম্মানসূচক পুরষ্কার' (অস্কার) প্রাপ্তি তাঁর জীবনের অন্যতম সেরা অর্জন।