গ্রন্থকার আরেফিন বাদল এই উপন্যাসের প্রথম সংস্করণের ভূমিকায় লিখেছিলেন, " সারা'র ব্রীজ' নিছক একটি প্রেমের গল্প..."। আসলে কি তাই? ষাটের দশকে মার্ক্সীয় রাজনীতির সফলতা-ব্যর্থতা এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের নির্মম বাস্তবতার বিশাল পটভূমিতে এই উপন্যাসের কাহিনী আবর্তিত। উপন্যাসটি অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত কলেবরে রচিত হলেও এর বিশাল-বিরাট ক্যানভাস যে কোনো বোদ্ধা পাঠকের মর্মমূলে প্রচণ্ডভাবেই নাড়া দিতে সক্ষম। বিশেষ করে এই উপন্যাসের সফলতার দুটি দিক হলো: এক. কোনো পাঠক যদি সমকালীন সমাজ-রাজনীতি, ইতিহাস-ঐতিহ্যের নির্মুহ উপস্থাপনায় আগ্রহী হন, সেক্ষেত্রে বিশ্বস্ত ইতিহাস-রাজনীতির নৈর্ব্যক্তিক বর্ণনা এতে পেতে পারেন। দুই. আবার কেউ যদি নির্ভেজাল প্রেম-কাহিনীর রোমান্সকর আস্বাদন পেতে চান, সে ক্ষেত্রেও পাঠককে নিয়ে যাবে চূড়ান্ত ক্লাইমেক্সে। আর- সবচেয়ে বড় কথা, 'সমকালীন রাজনৈতিক বাস্তবতা' এবং 'প্রেম কাহিনীর দ্বান্দ্বিক পদচারণা' পাশাপাশি অবস্থান ও বিচরণ ঘটলেও কোনো ক্ষেত্রেই একটি আরেকটির পথ অমসৃণ করে তোলেনি, কিংবা আরোপিত বলেও মনে হয়নি কোনো কিছু। এখানেই গ্রন্থকারের ব্যতিক্রমী সার্থকতা, যা রাজনৈতিক উপন্যাসের ক্ষেত্রে বিরল। # গ্রন্থকার পরিচিতি আরেফিন বাদল মূলত একজন ব্যতিক্রমী ধারার কথাসাহিত্যিক। নিজের দেখা ও অভিজ্ঞতালব্ধ সমকালীন রাজনীতি, বাঙালী জাতির উত্থান-পতন এবং সমাজের নানা অসঙ্গতি বস্তুনিষ্ঠভাবে তুলে ধরাই তাঁর গল্প-উপন্যাস-নাটকের বিষয়বস্তু। তাঁর উল্লেখযোগ্য গল্পগ্রন্থ: 'প্রসবোন্মুখ যন্ত্রণাবিদ্ধ' (১৯৭৮), 'আগামীকাল ভালোবাসার' (১৯৮০), 'Short Stories' (১৯৮১), 'অন্তুর বর সাজা' (১৯৯০), 'নিত্যদিন কালগোনা' (২০০৪), 'মুক্তিযুদ্ধের গল্প' (১৯১০), 'গল্প সমগ্র' (২০১৮), 'বিশ শব্দের গল্প' (২০২০), 'এই যুদ্ধ সেই যুদ্ধঃ মুক্তিযুদ্ধের গল্প' (২০২৩) ইত্যাদি। উপন্যাস: 'নিসর্গের সন্তানেরা' (১৯৮১), 'ঐ আসে আমিরালী' (১৯৯৯), 'ইমুবাবু' (১৯৯৮), 'সারা'র ব্রীজ' (১৯৯৯) [৪র্থ সংস্করণ], 'হাকিম উদ্দিন তরফদার' (২০০১), 'অতঃপর একটি স্যুটকেস' (২০১৭), 'উপন্যাস সমগ্র' (২০১৮), 'এবং মাতৃত্ব' (২০১৯)। টিভি নাটক 'কাছের মানুষ কাঁদে' (১৯৮৯), 'ঐ আসে আমিরালী' (১৯৮৯), 'ইমুবাবু' (১৯৯৭), 'আপন অস্তিত্বে', 'নেতা ঘেমে যাচ্ছেন' ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। কথা সাহিত্যের বাইরে তার গবেষণা গ্রন্থ: 'ঐতিহাসিক প্রেমপত্র' (১৯৭৬) (৩য় সংস্করণ), ও 'রবীন্দ্রনাথের জীবনে নারী' (১৯৯৯) [২য় সংস্করণ), 'মওলানা ভাসানী' (১৯৭৭) [২য় সংস্করণ), 'চাষী-মজুরের মওলানা ভাসানী' (২০২২), 'বাংলাদেশ-ভারত কনফেডারেশন: একাত্তরে ইন্দিরাকে ভাসানীর চিঠি' (২০২৩), 'Rabindranath's Fascinating Beau' Translated by Sazzad Haider) (২০২৩) ইত্যাদিসহ অন্যসব গ্রন্থগুলো তাঁর পেশার প্রয়োজনে কিংবা ফরমায়েশি লেখা। পেশাগত জীবনে তিনি সাংবাদিক, সম্পাদক, সরকারি আমলা হিসেবে বিভিন্ন সময়ে দায়িত্ব পালন করেছেন। এর বাইরে বাংলাদেশে বেসরকারিভাবে নির্মিত প্রথম টিভি (প্যাকেজ) নাটক- 'প্রাচীর পেরিয়ে' (১৯৯৪)-এর প্রযোজক-নির্মাতা তিনি। অত্যন্ত সাফল্যজনকভাবে তিনি তাঁর প্রতিষ্ঠিত ও সম্পাদিত পত্রিকাসমূহে (পাক্ষিক 'তারকালোক', সাপ্তাহিক 'আগামী', সাপ্তাহিক 'বিশ্ব বাঙালী', মাসিক 'কিশোর তারকালোক', মাসিক 'তারকালোক ডাইজেস্ট'-এ বাংলা ভাষায় প্রথম বাণিজ্যিকভাবে ডিটিপিতে বাংলা লিপির সাফল্যজনক ব্যবহার ১৯৮৭ খ্রি. থেকে শুরু করেন। দেশ-বিদেশে বিভিন্ন সেমিনার ও কনফারেন্সে যোগদান করেন তিনি। ১৯৮৭ সালে 'ভাসানী পদক', চ্যানেল আই প্রবর্তিত 'ফজলুল হক স্মৃতি পুরস্কার' (২০১৪), 'বাসসাচ চলচ্চিত্র পুরস্কার' (২০১৪), 'টাঙ্গাইল সাহিত্য সংসদ পুরস্কার' (২০১৬)-সহ বেশকিছু উল্লেখযোগ্য দেশি-বিদেশি পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেন; তিনি 'বাংলা একাডেমি'র একজন 'জীবন সদস্য'। আরেফিন বাদলের জন্ম ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ২৫ সেপ্টেম্বর শনিবার দুপুর বারোটায়, টাঙ্গাইল জেলায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি 'বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে' ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে জনাব বাদল মাঠ পর্যায়ের একজন সফল সংগঠক ও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন।
স্বাধীন বাংলার স্বপ্নদ্রষ্টা মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী একাত্তরে বাঙালির মহান মুক্তিযুদ্ধের শেষদিকে তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে পরপর দুটি ব্যক্তিগত চিঠি লিখেছিলেন বলে তথ্য পাওয়া যায়। চিঠি দুটির বিষয়বস্তু একই। বলা যায় পরের চিঠিটা আগেরটির তাগিদপত্র মাত্র। বেশকিছু বহুল আলোচিত ও বিতর্কিত বিষয়ের সাথে যে বিষয়টি নিয়ে প্রধানত নানা মহলে ব্যাপকভাবে আলোচিত, চর্চিত- তাহলো 'বাংলাদেশ—ভারত কনফেডারেশন' গঠন প্রসঙ্গ। স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন এই স্পর্শকাতর বিষয়টি নিয়েই মহল বিশেষ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রথম প্রবক্তা মওলানা ভাসানী সম্পর্কে নানা ধরনের অপপ্রচারে লিপ্ত রয়েছে। এখন অবধি কোন গবেষক কিংবা ইতিহাসবিদ এর মূল রহস্য উদঘাটনে তৎপর হতে দেখা যায়নি। স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে এসে মওলানা ভাসানী কেন আলোচ্য চিঠি দুটি লিখেছিলেন তা নিয়ে রীতিমত ভাবিত হওয়ার বিষয়ই বটে। জাতীয় স্বার্থেই এর গভীরে প্রবেশ অত্যন্ত জরুরি। 'বাংলাদেশ—ভারত কনফেডারেশন : একাত্তরে ইন্দিরাকে ভাসানীর চিঠি' বইটিতে আমরা তারই প্রতিফলন দেখতে পাবো। বইটির রচয়িতা সুসাহিত্যিক ও গবেষক আরেফিন বাদল মওলানা ভাসানীকে কাছ থেকে দেখেছেন ও দীর্ঘদিন ধরে তাঁকে বুঝবার চেষ্টা করেছেন। ১৯৭৬ সালে সাপ্তাহিক বিচিত্রার পক্ষ থেকে অসুস্থ্য মওলানা ভাসানীর সাক্ষাৎকার গ্রহণকালে তাঁর কাছে 'কনফেডারেশন' প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া একমাত্র জীবিত ব্যক্তি হিসেবে এটি তার দায়বদ্ধতা ও ঐতিহাসিক দায়িত্বও বটে। তারই ফসল এই বই। এই গ্রন্থে বিভিন্ন তথ্য—উপাত্তের সহায়তায় এর রহস্য উদঘাটনের চেষ্টা করা হয়েছে। এখানে গ্রন্থ—লেখকের নিজস্ব মতামত চাপিয়ে দেয়ার কোন প্রয়াস নেই। সংযোজিত তথ্য—উপাত্তের সংশ্লিষ্ট সূত্রও এগুলোর সাথেই সংযোজন করে দেয়া হয়েছে। কেনো এবং কোন্ পরিস্থিতির বাতাবরণে আলোচ্য চিঠি দুটির অবতারণা- তার প্রেক্ষাপট, মওলানা ভাসানীর উদ্দেশ্য, আন্তরিক তাগিদ কিংবা রাজনৈতিক কৌশল বা অন্য কোন অনুসঙ্গ; সেটির অন্বেষণের প্রয়াসই এই গ্রন্থ। আমাদের বিশ্বাস, গ্রন্থটি পাঠ করলে পাঠক নিজেই একটা সুস্পষ্ট সিদ্ধান্তে আসতে সক্ষম হবেন। এবং তা যদি হয়, সেটিই হবে আমাদের শ্রমের স্বার্থকতা। আমরা বিশ্বাস করি, ভবিষ্যতে অনেক গবেষণাকর্মী এই বিষয়ে আরো তথ্যনির্ভর বস্তুনিষ্ঠ গবেষণাকর্ম উপহার দিয়ে জাতীয় দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হবেন। ভাসানী গবেষণা প্রকল্পের তৃতীয় বই এটি।