হাওরবেষ্টিত সুনামগঞ্জ দেশের কৃষিজ ও মৎস্য সম্পদের একটি সমৃদ্ধ উৎস। নদী ও হাওরবিধৌত এ জেলার পলিসমৃদ্ধ উর্বর নিম্নভূমিতে প্রতি বছর প্রায় ৬০ জাতের ধানের চাষ হয়, যার বর্তমান (২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ) আর্থিক মূল্য প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। ২০২৪ সালে সুনামগঞ্জ জেলায় মোট ২ লাখ ৫২ হাজার হেক্টর জমিতে ধানের আবাদ হয়েছে এবং প্রায় ১৪ লাখ মেট্রিক টন বোরো, ৩ লাখ মেট্রিক টন আমন, ৩০ হাজার মেট্রিক টন আউশ ধানসহ অন্যান্য উফশী জাতের ধান উৎপাদিত হয়েছে। জেলার অভ্যন্তরীণ ৯ লাখ মেট্রিক টন ধানের চাহিদা মিটিয়ে উদ্বৃত্ত ৮ লাখ মেট্রিক টন ধান সারাদেশে সরবরাহ করা হয়েছে। এ বিপুল পরিমাণ ধানের উৎপাদনের মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরীণ খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে ভূমিকা রাখছে সুনামগঞ্জের কৃষক ও কৃষি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিগণ। বর্ষা মৌসুম থেকে নিম্নভূমিসমূহ প্লাবিত হলে এ অঞ্চলের মানুষ নির্ভর করে মৎস্য সম্পদের ওপর। সুনামগঞ্জে বর্তমানে (২০২৪) ৬৩১টি নিবন্ধিত মৎস্যজীবী সমিতি ও মোট ১,২১,৪৭৩ জন মৎস্যজীবী রয়েছে। জেলা মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্যানুসারে, আয়তনের দিক থেকে ২০ একরের ঊর্ধ্বে জলমহাল রয়েছে ৪২০ টি এবং ২০ একরের নিচে জলমহাল রয়েছে ৫৫৬টি। বিভিন্ন জলাশয় এবং হাওরের স্বাদুপানির উন্মুক্ত ও বদ্ধ জলমহালসমূহ হতে আহরিত হয় মোট ১২৬ প্রজাতির মাছ, যার বর্তমান (২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ) বার্ষিক বাজারমূল্য প্রায় চার হাজার কোটি টাকা। সুনামগঞ্জে মাছের অভ্যন্তরীণ চাহিদা ৫৬,৩৭২ মেট্রিক টনের বিপরীতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সুনামগঞ্জ জেলায় মাছ উৎপাদিত হয়েছে মোট ১,১৫,০৬৯ মেট্রিক টন। ফলে উদ্বৃত্ত ৫৮,৬৯৭ মেট্রিক টন মাছ দেশে-বিদেশে সরবরাহ করে দেশের মানুষের আমিষের চাহিদা পূরণ ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে ভূমিকা রাখা সম্ভব হচ্ছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মোট ৩৫০ মেট্রিক টন মাছ প্রক্রিয়াজাত করে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হয়েছে, যার আর্থিক মূল্য বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ১৫ কোটি টাকা। ধান ও মাছের সম্ভাবনাকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর পাশাপাশি সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসন নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছে। জেলা প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের সমন্বিত উদ্যোগে ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত হয় প্রায় ৬০২ কিলোমিটার দীর্ঘ ফসল রক্ষা বাঁধ। বাঁধের কাজের প্রকল্প নির্ধারণ, গণশুনানির মাধ্যমে পিআইসি গঠন, বাঁধ নির্মাণ কাজের তদারকি, অভিযোগের সরেজমিন তদন্ত - ইত্যাদি কর্মযজ্ঞের মাধ্যমে বোরো ধানকে আগাম বন্যার কবল থেকে রক্ষা করতে জেলা প্রশাসন সক্রিয় ভূমিকা পালন করে থাকে। ১৫ ডিসেম্বর থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে বাঁধ নির্মাণের কর্মপ্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে স্বচ্ছতার সাথে সম্পাদনের লক্ষ্যে কাবিটা নীতিমালা-২০২৩ কঠোরভাবে অনুসরণ করা হয়। প্রতিবছর ক্রপ ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ধান কর্তন উৎসব আয়োজন এবং পরবর্তীতে কৃষকদের কাছ থেকে ন্যায্যমূল্যে ধান সংগ্রহ নিশ্চিতকরণে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর সমন্বয়ে সচেষ্ট থাকে জেলা প্রশাসন। জেলার মৎস্যসম্পদকে সমৃদ্ধকরণের পাশাপাশি সরকারের রাজস্ব আদায় নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জেলা প্রশাসন জলমহালসমূহ ব্যবস্থাপনা করে থাকে। হাওর অধ্যুষিত সুনামগঞ্জে মোট জলমহাল রয়েছে ১০২৮টি। এই বিপুলসংখ্যক জলমহালের ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সরকারি জলমহাল ব্যবস্থাপনা নীতি, ২০০৯ অনুসারে জলমহালের তালিকা প্রণয়ন, ইজারা প্রদান, খাস আদায়, তদন্ত প্রক্রিয়া, অবৈধ মৎস্য আহরণ ও ইজারার শর্ত ভঙ্গ হলে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা ইত্যাদি কাজ সম্পাদন করে থাকে জেলা প্রশাসন। সরকারের উদ্যোগে সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার ওয়েজখালীতে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও সরঞ্জামসমৃদ্ধ একটি মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে, যা সার্বিকভাবে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে মৎস্যজীবীদের জীবিকার ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এছাড়া দিরাই উপজেলায় অপর একটি মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। সুনামগঞ্জে উৎপাদিত ও আহরিত এই কৃষিজ ও মৎস্য সম্পদ একদিকে যেমন দেশের অভ্যন্তরীণ খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা মেটাচ্ছে, অপরদিকে এ অঞ্চলের উদ্বৃত্ত ধান ও মাছ বিদেশে রপ্তানি করে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রার্জনের সম্ভাবনা হাতছানি দিচ্ছে। বর্তমানে সুনামগঞ্জ সদরের ওয়েজখালীতে অবস্থিত একটি মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা থেকে মাছ প্রক্রিয়াজাত করে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হচ্ছে। এরূপ কারখানা স্থাপনের মাধ্যমে মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণে গতিশীলতা বৃদ্ধি করা সম্ভব। এছাড়া মৎস্য গবেষণাগার স্থাপন করে এ অঞ্চলের মাছের বিচিত্র জাতসমূহকে সংরক্ষণ ও উৎপাদন বৃদ্ধিকরণের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম খাত মৎস্যখাতকে আরো সমৃদ্ধকরণ সম্ভব হবে। সুনামগঞ্জ পুরাতন এসডিও অফিস তথা জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ভবনে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে সুনামগঞ্জ ঐতিহ্য জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। জাদুঘরটিতে এ জেলার পরিবেশ, প্রাকৃতিক সম্পদ, সংস্কৃতি, মুক্তিযুদ্ধসহ নানা স্মৃতিবিজড়িত দিক তুলে ধরা হয়েছে। পরবর্তীতে ২০২৪ সালে জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে জাদুঘরটিতে ব্যাপক পরিসরে উন্নয়ন, সংস্কার, সৌন্দর্যবর্ধন ও সংগ্রহ বৃদ্ধির বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। জাদুঘরে হাওরে মৎস্য আহরণ ও কৃষিকাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন সরঞ্জাম সংরক্ষিত আছে। এখানে হাওরের মিঠা পানির ৭০ প্রজাতির মাছ সংরক্ষণ করা হয়েছে। এছাড়াও ৫১ প্রজাতির ধান সংরক্ষিত রয়েছে। জেলায় ধান ও মাছের উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনায় বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়। সুনামগঞ্জের উত্তরে অবস্থিত মেঘালয় অঞ্চলে পৃথিবীর সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত হয়। মেঘালয়ের পাহাড়ি ঢল ও সুনামগঞ্জে অতিবৃষ্টির মিলিত প্রভাবে প্রায়ই বন্যা প্লাবিত হয় এ অঞ্চলের নিম্নভূমি, যার ফলে অনেকসময় আগাম বন্যায় ধানের ক্ষতি হয়, ভেসে যায় খামারের মূল্যবান মাছ। সুনামগঞ্জের বেশিরভাগ উপজেলা দুর্গম। উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে না ওঠা এবং প্রয়োজনীয়সংখ্যক জলযানের সংকট থাকায় ফসল রক্ষা বাঁধ তদারকির কাজ যথাযথভাবে করা অত্যন্ত দুরূহ হয়ে পড়ে। হাওর এলাকায় জলবায়ু পরিবর্তন, পলিজমা হওয়া, অপরিকল্পিত বাঁধের ফলে মাছের আবাসস্থলের সাথে সাথে মাছের প্রজননক্ষেত্রগুলো নষ্ট হচ্ছে। তাছাড়া হাওর এলাকায় যখন পানিতে প্লাবিত হয়ে যায় তখন জেলে সম্প্রদায়গণের মাছ ধরা ছাড়া আর বিকল্প কোন কর্মসংস্থানের সুযোগ না থাকায় তারা বিভিন্ন ধরনের জাল দ্বারা সার্বক্ষণিক মাছ ধরে এবং মাছ ধরেই জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। বর্তমানে হাওর এলাকায় ৭০-৮০ প্রজাতির দেশীয় মাছ পাওয়া যায়। ক্রমাগত পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে ১০-১৫ প্রজাতির মাছের অস্তিত্ব ইতোমধ্যেই সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছে। হাওরের মাছের প্রজননক্ষেত্রগুলোতে পলি অপসারণ করা এবং নদীর সাথে বিলগুলোর সংযোগ স্থাপন করা মাছের বিলুপ্তি রোধে অত্যন্ত জরুরি। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় হাওরাঞ্চলে দেশীয় প্রজাতির মাছের প্রজননের সময় (মে-জুলাই) নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পাশাপাশি জেলেদের জন্য বিশেষ ভিজিএফের মাধ্যমে প্রণোদনা প্রদান করা গেলে আরও অধিক পরিমাণ মাছ হাওর থেকে পাওয়া যাবে। এ জেলায় পর্যাপ্তসংখ্যক জলাধার না থাকার ফলে বোরো মৌসুমে পানি সংকট তৈরি হয়। তাই জলাধার নির্মাণ করা হলে খরা মৌসুমে ফসলের জমিতে সেচ প্রদান করা যাবে, ফলে কৃষকের সেচ খরচ কমে গিয়ে ফসলের উৎপাদন খরচ হ্রাস পাবে। এছাড়া হাওরের জলাবদ্ধতা নিরসনের ফলে বোরো ধান আগাম রোপণ সম্ভব হবে ফলে আগাম বন্যার থেকে ফসলহানির আশঙ্কা কমবে। ‘রুপালি মাছ, সোনালি ধান : সুনামগঞ্জের সম্ভাবনার গান’ গ্রন্থটি কালের বিবর্তনে এ জেলার ধান ও মাছের বিভিন্ন জাতের পরিচয় ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার পাশাপাশি এগুলো সংরক্ষণে সকলকে সচেতন করে তুলবে মর্মে আশা করা যায়।