নজরুল বজ্র-বিদ্যুতে ঝড় তুলেছেন বাঙালির মনে-প্রাণে, চির তারুণ্যের-যৌবনের। উদ্দাম, উচ্চকণ্ঠ, কোলাহলময় ভাষায়। প্রবল প্রসন্ন প্রাণের পরিপূর্ণ প্রতীক হয়ে। তাঁর দুর্বার প্রাণশক্তি ভাষায় এনেছে তীক্ষ্ণতা, ছন্দে এনেছে জীবনস্পন্দন, ভাবে এনেছে বল-বীর্য ও তেজের উদ্দীপ্তি। কুড়ি বছরের সৃষ্টিশীল জীবনে উপন্যাস মাত্র তিনটি। আর সেই তিনটি উপন্যাসেই তিনি অনন্য-অসামান্য। নিম্নবর্গের মানুষের জীবনসংগ্রাম উঠে এসেছে নজরুলের ‘মৃত্যুক্ষুধা’য়। বঞ্চিত দলিত ও প্রান্তবাসী জনগোষ্ঠীর কথা তীব্রভাবে সঞ্চারিত করেছে তাঁর আয়ুধকে। ‘বাঁধনহারা’র বিপ্লবের আকাক্সক্ষা কিংবা ‘কুহেলিকা’র তীব্র রোমান্স-- ঔপন্যাসিক নজরুলের সামর্থ্যকেই পুনঃপ্রতিভাত করে। বাংলা কথাসাহিত্যের দিগন্তে যা অতুলনীয়। ঔপনিবেশিক শাসনামলের জটিল সময়-সংক্রান্তিতে বাংলার সাহিত্য-রাজনীতিতে আবির্ভাব তাঁর অথচ স্বকালের অপরাপর সাহিত্যিকের ন্যায় তিনি নিছক অনুগামী নন। ভিন্নতার সাধনায় নজরুল অতিক্রম করেছেন দীর্ঘ-দুরূহ পথ। মহৎ স্রষ্টা-লেখক, কবি, শিল্পী বাঁচেন তাঁর রেখে যাওয়া উত্তরাধিকারের মধ্যে, সৃষ্টির মধ্যে। জনচিত্তে তাঁর স্থায়িত্ব নির্ণীত হয় সেই অনপনেয় চিহ্ন থেকেই। কালের সে বিচারে বাঙালির জীবনে, বিশ্বের সাহিত্যাকাশে কাজী নজরুল ইসলাম অনন্য, অমোচনীয়। বাঙালি সমাজের ধর্মভেদবুদ্ধিহীন এক মিলিত, সমন্বিত সংস্কৃতির কাণ্ডারী। নজরুলের তিন উপন্যাস আজও আমাদের অবশ্যপাঠ্য।
১৮৯৯ সালের ২৪ মে (১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ) পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, গীতিনাট্যকার, অভিনয়শিল্পী, সুরকার ও প্রবন্ধকার। নজরুলের বাল্যকাল কেটেছে দুঃখ-দুর্দশায়। তাই তাঁর ডাকনাম ছিলো দুখু মিয়া। তাঁর বৈচিত্র্যময় শিক্ষাজীবন শুরু হয় গ্রামের মক্তবে। পিতৃহীন হওয়ার পর তিনি পড়ালেখা ছেড়ে যোগ দেন লেটোর দলে, যেখান থেকে তিনি কবিতা ও গান রচনার কৌশল রপ্ত করেন। পরবর্তীতে এক বছর ময়মনসিংহের দরিরামপুর হাই স্কুলে পড়ে পুনরায় চুরুলিয়ায় রানীগঞ্জের শিয়ারসোল রাজ স্কুলে ভর্তি হন, এবং সেখানে তিন বছর অধ্যয়ন করেন। প্রবেশিকা পরীক্ষার আগেই তাকে পড়ালেখা ছাড়তে হয় যুদ্ধে যোগদানের জন্য। যুদ্ধের দিনগুলোতে নানা জায়গায় অবস্থান করলেও তার করাচির সৈনিকজীবনই উল্লেখযোগ্য, কেননা সেসময়েই তার প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায় ‘বাউণ্ডেলের আত্মকাহিনী’ নামক গল্প প্রকাশের মাধ্যমে। কাজী নজরুল ইসলাম এর বই সমূহ’র বিষয়বস্তু বিবিধ। তবে কাজী নজরুল ইসলাম এর বই-এ সমকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক যন্ত্রণা এবং সাম্যবাদের ধারণা প্রকটভাবে স্থান করে নিয়েছে। রাবীন্দ্রিক যুগে তার সাহিত্য প্রতিভা উন্মোচিত হলেও তার সৃষ্টি সম্পূর্ণ ভিন্ন। কাজী নজরুল ইসলাম এর বই সমগ্র এর মাঝে উল্লেখযোগ্য হলো ‘রিক্তের বেদন’, ‘দোলনচাঁপা’, ‘বিষের বাঁশি’, ‘সাম্যবাদী’, ‘সর্বহারা’, ‘প্রলয়শিখা’ ইত্যাদি। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী নজরুল ‘সাপ্তাহিক লাঙল’, দ্বিসাপ্তাহিক পত্রিকা ‘ধূমকেতু’র সম্পাদক ছিলেন। বাংলাদেশের জাতীয় কবি এবং বাংলা সাহিত্যের বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ২৯ আগস্ট ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।