প্রথম পরিচ্ছেদ রামতারণ চৌধুরী সকালে উঠিয়া বড় ছেলে নিধুকে বলিলেন, "নিধে, একবার হরি বাগদীর কাছে গিয়ে তাগাদা করে দ্যাখ দিকি। আজ কিছু না আনলে একেবারেই গোলমাল।" নিধুর বয়স পঁচিশ, এবার সে মোক্তারী পরীক্ষা দিয়া আসিয়াছে, সম্ভবত পাশও করিবে। বেশ লম্বা দোহারা গড়ন, রঙ খুব ফরসা না হলেও তাহাকে এ পর্যন্ত কেউ কালো বলে নাই। নিধু কী একটা কাজ করিতেছিল, বাবার কথায় আসিয়া বলিল, "সে আজ কিছু দিতে পারবে না।" "দিতে পারবে না তো আজ চলবে কী করে? তুমি বাপু একটা উপায় খুঁজে বার করো, আমার মাথায় তো আসচে না।" "কোথায় যাব বলুন না বাবা? একটা উপায় আছে-ও পাড়ার গোঁসাই-খুড়োর বাড়িতে গিয়ে ধার চেয়ে আনি না হয়।" "সেইখানে বাবা আর গিয়ে কাজ নেই-তুমি একবার বিন্দুপিসীর বাড়ি যাও দিকি।" গ্রামের প্রান্তে গোয়ালাপাড়া। বিন্দু গোয়ালিনীর ছোট্ট চালাঘরখানি গোয়ালাপাড়ার একেবারে মাঝখানে। তাহার স্বামী কৃষ্ণ ঘোষ এ গ্রামের মধ্যে একজন অবস্থাপন্ন লোক ছিল। বাড়িতে সাত-আটটা গোলা, পুকুর প্রায় একশোর কাছাকাছি গরু ও মহিষ-কিছু তেজারতি কারবারও ছিল সেই সঙ্গে। দুঃখের মধ্যে ছিল এই যে, কৃষ্ণ ঘোষ নিঃসন্তান। অনেক পূজামানত করিয়াও আসলে কোনো ফল হয় নাই। সকলে বলে স্বামীর মৃত্যুর পরে বিন্দুর হাতে প্রায় হাজার পাঁচেক টাকা পড়িয়া ছিল।
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বেশ কিছু কালজয়ী উপন্যাস রচনার মাধ্যমে জয় করে নিয়েছেন বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের হৃদয়। শুধু উপন্যাসই নয়, এর পাশাপাশি তিনি রচনা করেছেন বিভিন্ন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, দিনলিপি ইত্যাদি। প্রখ্যাত এই সাহিত্যিক ১৮৯৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন, তবে তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল যশোর জেলায়। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র হিসেবে তিনি শিক্ষাজীবন অতিবাহিত করেন, যার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর প্রথম বিভাগে এনট্রান্স ও আইএ পাশ করার মাধ্যমে। এমনকি তিনি কলকাতার রিপন কলেজ থেকে ডিস্টিংশনসহ বিএ পাশ করেন। সাহিত্য রচনার পাশাপশি তিনি শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন অতিবাহিত করেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমূহ এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো 'পথের পাঁচালী', যা দেশ ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হওয়ার মাধ্যমে। এই উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ করে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় অর্জন করেছেন অশেষ সম্মাননা। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই এর মধ্যে আরো উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো 'আরণ্যক', 'অপরাজিত', 'ইছামতি', 'আদর্শ হিন্দু হোটেল', 'দেবযান' ইত্যাদি উপন্যাস, এবং 'মৌরীফুল', 'কিন্নর দল', 'মেঘমল্লার' ইত্যাদি গল্পসংকলন। ১০ খণ্ডে সমাপ্ত ‘বিভূতি রচনাবলী’ হলো বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমগ্র, যেখানে প্রায় সাড়ে ছ’হাজার পৃষ্ঠায় স্থান পেয়েছে তার যাবতীয় রচনাবলী। খ্যাতিমান এই সাহিত্যিক ১৯৫০ সালের ১ নভেম্বর বিহারের ঘাটশিলায় মৃত্যুবরণ করেন। সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি মরণোত্তর 'রবীন্দ্র পুরস্কারে' ভূষিত হন।