মুক্তিযুদ্ধে যেমন বাংলাদেশের নারীরা প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছেন অথচ তারা ইতিহাসে দৃশ্যমান নন এবং শুধু নির্যাতনের শিকার হিসেবেই চিহ্নিত, সেই রকমই সীমান্তের ওপারে যে নারীরা অপার মমতায় অক্লান্ত খাটুনি দিয়ে শরণার্থীদের প্রাণে এবং মনে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন, তাদের অবদানের যথাযথ উল্লেখ খুঁজে পাওয়া যায় না ইতিহাসের পাতায়। অথচ এ ধরনের ঘটনা কোনাে দৃষ্টিভঙ্গিতেই গ্রহণযােগ্য নয়। অসম্পূর্ণ, অসত্য বা অর্ধসত্য বর্ণনা কখনােই ইতিহাসের মর্যাদা পেতে পারে না। সেদিকে লক্ষ রেখে আইন ও সালিশ কেন্দ্র হাতে নেয় মুক্তিযুদ্ধে নারীর ভূমিকা সম্পর্কিত মৌখিক ইতিহাস প্রকল্প। মৌখিক ইতিহাস প্রকল্পের আওতাভুক্ত আছে, একাত্তরে ধর্ষণের শিকার। বাঙালি মেয়ের নির্যাতন কাহিনীর পাশাপাশি পাহাড়ি নারীর সংগ্রামের কথাও। তাছাড়া এ কাজ করতে গিয়ে দেশের গণ্ডির বাইরে আমরা দৃষ্টি ফেলতে চেষ্টা করেছি। সেই সূত্রেই উঠে এসেছেন এই গ্রন্থের লেখিকা অঞ্জলি লাহিড়ী। যিনি মুক্তিযুদ্ধের পুরাে সময়টাতে নিজের দৈনন্দিনতাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে সিলেট-মেঘালয় সীমান্তের শরণার্থী। ক্যাম্পে ক্যাম্পে কাটিয়েছিলেন। নয় মাস ব্যাপী তার বিচিত্র অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রকাশিত হয় মৌখিক ইতিহাস প্রকল্পের আওতাভুক্ত প্রথম। প্রকাশনা স্মৃতি ও কথা-১৯৭১
অঞ্জলি লাহিড়ীর জন্ম ১৯২২ সালে, কলকাতা রাজা নবকৃষ্ণ স্ট্রিটে ঠাকুরদার বাড়িতে। দশ মাস বয়সে শিলং চলে আসেন। মায়ের সঙ্গে। মা সুবর্ণপ্রভা দাস তখন জেলরােড গার্লস্ স্কুলের শিক্ষকতার চাকরি নিয়ে শিলং-এ বসবাস শুরু করেন। সেই স্কুল থেকে ক্লাস সিক্স পর্যন্ত পড়ে ময়মনসিংহের বিদ্যাময়ীতে ছিলেন এক বছর । তারপর কলকাতার ভিক্টোরিয়া ইনস্টিটিউট থেকে ম্যাট্রিক দেন। অঞ্জলি লাহিড়ীর ইচ্ছে ছিল, কলকাতায় থেকে কলেজে পড়ার । ততােদিনে বামপন্থী আন্দোলনের ঢেউ দেয়াল টপকে ঢুকে পড়েছে মহানগরীর স্কুল-কলেজে। মা আর দাদা তাঁর মতলব টের পেয়ে গেলেন। অনশন করে, মেঝেতে গড়াগড়ি দিয়েও কোনাে ফল পাওয়া গেল না। শিলং-এর সেন্ট মেরি’স কলেজে ভর্তি হতে হলাে তাকে। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। শিলং-এর রাস্তাঘাটে দেশি-বিদেশি সৈন্যরা সব টহল দিয়ে বেড়ায়। এ অবস্থায় অঞ্জলি লাহিড়ী মাকে গিয়ে বললেন, পড়াশােনা করতে হলে তাকে যুদ্ধের ডামাডােল থেকে বেরিয়ে সিলেট চলে যেতে হবে। দিদি কল্যাণী দাস তখন ওখানকার রেডক্রসের ডাক্তার। সিলেটে এসে কোথায় পড়াশােনা, কোথায় কী ।। ময়মনসিংহের বান্ধবী কল্যাণী সেন ঢাকা হয়ে সিলেট পৌছে গেলেন। বিদ্যাময়ীতে পড়ার সময় পঞ্চম এডওয়ার্ডের ছবি পােড়ানাের অভিযােগে কল্যাণী স্কুল। থেকে বহিস্কৃত হন। অঞ্জলি লাহিড়ীকে তখন সতর্ক করে দেয়া হয়েছিল, এ ধরনের রাষ্ট্রদ্রোহী কাজ যেন তিনি । ভবিষ্যতে আর না করেন। এখন মাথার ওপর বিদ্যাময়ীর দিদিমণিরাও নেই আর স্কুলের গণ্ডি তাে সেই কবেই তারা পেরিয়ে এসেছেন। দুই বান্ধবী ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে যােগ দিয়ে সিলেটের গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ান, কখনােসখনাে আসাম ভ্যালিতেও তাদের ডাক পড়ে । এ অবস্থায় কেবল মায়ের মুখ চেয়ে তিনি ইন্টারমেডিয়েট পরীক্ষাটা দিয়েছিলেন। তারপর পড়াশােনায় ইস্তফা দিয়ে পুরােদমে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়লেন। দেশ ভাগের পর বি.এ পাস করেন। তিনি তখন অল আসাম গার্লস্ স্টুডেন্ট অ্যাসােসিয়েশনের সেক্রেটারি। তারপর তাে। আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকা, জেল খাটা এসব হলাে। ষাটের দশকের শুরুতে পার্টি বিভাজনের পর রাজনীতি ছেড়ে দেন। সেই থেকে নানা রকম সমাজসেবার কাজ করে যাচ্ছেন। অঞ্জলি লাহিড়ী ডায়েরি আকারে সব সময়ই কিছু না কিছু লিখেছেন। সিলেট-মেঘালয় সীমান্তবর্তী শরণার্থী শিবিরের কাজের অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন এই বই স্মৃতি ও কথা ১৯৭১। তাছাড়া সুনামগঞ্জের এক শহীদ মুক্তিযােদ্ধাকে নিয়ে লিখেছেন। জগজ্যোতি। খাসিয়াদের জীবন নিয়ে তাঁর লেখা বই বিলােরিস এবং সােনার সিঁড়ির উপকথা প্রকাশিত হয়েছে কলকাতা থেকে। অনূদিত গ্রন্থ অসমের। মহিলা কথাকার’র জন্য লীলা রায় স্মৃতি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। অঞ্জলি লাহিড়ীর অন্যান্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে সুবর্ণপ্রভা দাস ও তৎকালীন নারী সমাজ এবং পামভিউ নার্সিংহােম। নব্বইয়ে পা দেয়া অঞ্জলি লাহিড়ী শিলং-গৌহাটি দু’জায়গায়ই থাকেন পুত্র রাহুল ও বােনের ছেলে সুরজিত দত্তকে নিয়ে। ২০০৬ সালে এক সময়ের কমরেড ও দীর্ঘদিনের সঙ্গী নীরেন লাহিড়ী মারা গেছেন। একমাত্র মেয়ে বুলবুলি জার্মানি-প্রবাসী।