সাইকেল রিক্সাটাকে ছেড়েই দিতে হল। বাড়ি চেনে না তাই সাইকেল রিক্সায় চেপে ঘুরে ঘুরে এ দরজায় ও দরজায় জিজ্ঞেস করতে লজ্জা করছিল সবুজের। তবে, পাড়াটা ঠিকই চিনেছে। পাড়া ভুল হয়নি ওর। কিন্তু কিছুই আর চেনা যায় না। সেই ধাবার পাশের পানের দোকান নেই, চায়ের দোকানও না। একটা হাট ছিল এদিকে বুধবারে বসত। খয়রাগুড়ির হাট। এখন আর কিছুই নেই। পাড়াটার নামই রয়ে গেছে শুধু খয়রাপাড়া। এখন এ-পাড়ায়ও অনেক বাড়ি-ঘর হয়ে গেছে। চিরদিনের চিহ্ন হিসেবে যেসব মহীরূহ ছিল এ পথ ও পথের মােড়ে মােড়ে সেগুলাের বেশির ভাগই ভূমি-গ্রাসী মানুষ কেটে ফেলেছে। গাছগুলােকে এক-একটা প্রতিষ্ঠানের মত মনে হত শাখা-প্রশাখায় পাতায়-কুরিতে,পাখির কলকাকলিতে ভরা সেই গাছগুলাে ছিল ভােরের গােলাপী আর শেষ বিকেলের সােনা-গলা রােদের নাচমঞ্চ।
যেখানে এক সময় শান্তি ছিল, অবকাশ ছিল, নির্জনতা ছিল, ভালােবাসার পরিবেশ ছিল,সেখানে সাইকেল রিক্সার প্যাক-প্যাক, ফেরীওয়ালার চীৎকার, ধুলাে, পথের পাশের নদৰ্মার পুতিগন্ধ জল আর নর্দমার ইদুরের মত খাই-খাই মানুষ ; এই-ই সব। বৌদি বলেছিলাে যে, তােষা এখন এখানেই।ও চলে এসেছে কোলকাতা থেকে। এখানের মেয়েদের স্কুলে পড়ায়। কোলকাতায় সন্দীপন না কী একটি সুন্দরী চাকুরে মেয়েকে নিয়ে থাকে। বৌদি দুঃখ করেছিলেন : সন্দীপনের মত দারুণ ভাল ও মেধাবী ছেলেও এমন করতে পারলাে? দাদা বলেছিলাে,এমন যে হতে পারে, আমার মনে তেমন সন্দেহ ছিল।ওদের বিয়েটা সমানে সমানে হয়নি। সন্দীপন তােৰ্ষার তুলনায় সবদিক দিয়ে ভাল ছিল। চেহারা গুণ বংশ-গৌরব সব দিক দিয়ে।
বুদ্ধদেব গুহ একজন ভারতীয় বাঙালি ঔপন্যাসিক ও সংগীতশিল্পী। তিনি ১৯৩৬ সালের ২৯ জুন কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। বন, অরণ্য ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখার মাধ্যমে পাঠকহৃদয় জয় করে নেওয়া এই লেখকের জীবন অভিজ্ঞতা ও বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে তিনি পড়াশোনা শেষ করেন। এরপর নিয়মিত লেখালেখি শুরু করেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘জঙ্গলমহল’। রচনাশৈলীর অনন্যতা ও স্বাতন্ত্র্য তাকে বাঙালি পাঠকের অন্যতম প্রিয় লেখকে পরিণত করেছে। বুদ্ধদেব গুহ কবিতা, ছোটগল্প ও উপন্যাস রচনা করেছেন, যা তাকে খ্যাতির চূড়ায় নিয়ে গিয়েছে। তাঁর সৃষ্ট বিখ্যাত চরিত্র ঋজুদা যেন তাঁর মতোই পরিব্রাজক। সে বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায় তার সঙ্গী রুদ্রকে নিয়ে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করে আসা এই লেখক অরণ্যকে যেমন তাঁর লেখার এক মূল আধেয় হিসেবে ধরে নিয়েছেন, তেমনই তাঁর লেখাগুলোর পটভূমিও ছিল পূর্ব বাংলার গহীন অরণ্য। এর সাথে তিনি সমাজের উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জীবনযাপন তাঁর লেখনীতে তুলে ধরেছেন, যা তাকে খুব সহজেই খ্যাতির পাত্রে পরিণত করে। বুদ্ধদেব গুহ প্রেমের উপন্যাস রচনা করেছেন বেশ কয়েকটি। এর মাঝে ‘হলুদ বসন্ত’ অন্যতম। বাংলা কথাসাহিত্যে এমন রোমান্টিসিজমের সংযোজন খুব কম লেখকই করতে পেরেছেন। পাঠকনন্দিত বুদ্ধদেব গুহ এর উপন্যাস সমগ্র হলো ‘মাধুকরী’, ‘একটু উষ্ণতার জন্য’, ‘নগ্ন নির্জন’, ‘অববাহিকা’, ‘পরদেশিয়া’, ‘সবিনয় নিবেদন (পত্রোপন্যাস)’, ‘আলোকঝারি’ ইত্যাদি। ছোটদের জন্য লিখেছেন ‘ঋজুদা’ সিরিজ। তাঁর রচিত ‘মাধুকরী’ উপন্যাস একইসাথে বিতর্কিত ও তুমুল জনপ্রিয়। বুদ্ধদেব গুহ এর বই সমগ্র শুধু উপন্যাস হিসেবে নয়, নগর ও অরণ্যের স্তুতি হিসেবে পাঠকের কাছে ভালোবাসার স্থান পেয়েছে। লেখালেখির পাশাপাশি তিনি একজন চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট এবং একজন নামকরা সঙ্গীতশিল্পীও বটে। বুদ্ধদেব গুহ এর বই সমূহ থেকে নির্মিত হয়েছে একাধিক টিভি অনুষ্ঠান ও চলচ্চিত্র। ১৯৭৭ সালে তিনি আনন্দ পুরস্কার পান। তাঁর রচনার জন্য তিনি বাংলা কথাসাহিত্যে এক মাইলফলক তৈরি করেছেন।