রবীন্দ্রনাথই বাংলা সাহিত্যে সর্বপ্রথম আমাদের সামাজিক ও পারিবারিক জীবনের সংকীর্ণ ও অকিঞ্চিৎকর বহির্বিকাশের দিক হতে দৃষ্টি ফিরিয়ে জীবনের তলদেশে যে নিভৃত ফল্গুধারাটি তা আমাদের দেখিয়ে দিলেন। দেখলাম, সেখানে ঘরের কোণে নদীর ঘাটে, সহস্র তুচ্ছ পরিচিত ও আবেষ্টনে কত সহস্র তুচ্ছ ঘটনা খুঁটিনাটি উপলক্ষ করে আমাদের জীবনে বিচিত্র আশা-আকাক্সক্ষা অবিরত স্পন্দিত হচ্ছে, অসংখ্য ক্ষুদ্র বিক্ষোভ আন্দোলিত হচ্ছে। আমাদের দৈনন্দিন কার্যের মধ্যে সেখানে অপরূপ মাধুর্য সুগভীর ভাবরসে বিধৃত হয়ে আছে। আমাদের বৈচিত্র্যবিহীন বাইরের জীবন সেখানে বৈচিত্র্যে ভরপুর, আবেগে চঞ্চল, সেখানে তার কোনো দৈন্য নেই, কোনো অভাব নেই। রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিচিত্তের অপূর্ব সুগভীর সহানুভ‚তি ও সূ² অর্ন্তদৃষ্টি দিয়ে আমাদের জীবনের এই নিভৃত গোপন প্রবাহটি আবিষ্কার করে তাকে আপন ভাব ও কল্পনায়, রূপে ও রসে আমাদের সম্মুখে ধরিয়ে দিলেন। আমরা একটি নতুন জগৎ ও জীবনের সন্ধান পেয়ে বিমুগ্ধ বিস্ময়ে চেয়ে রইলাম। কিন্তু একথা সত্য হোক বা না হোক, এই গল্পগুলোর মধ্যে কবিচিত্তের যে গভীর ভালোবাসা, যে সহানুভ‚তিময় দৃষ্টি পাঠকচিত্তের নিকটতর করেছে, রবীন্দ্র-পূর্ব বাংলা সাহিত্যে তার তুলনা নেই।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একাধারে ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার, চিত্রশিল্পী, সংগীতস্রষ্টা, অভিনেতা, কন্ঠশিল্পী, কবি, সমাজ-সংস্কারক এবং দার্শনিক। গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য প্রথম বাঙালি হিসেবে ১৯১৩ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬১ সালের ৭ মে তৎকালীন ব্রিটিশ-শাসিত ভারতে কলকাতার ধনাঢ্য ও সংস্কৃতিমনা জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব থেকেই তিনি লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন। ভানুসিংহ ঠাকুর ছিল তাঁর ছদ্মনাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই মানেই এক মোহের মাঝে আটকে যাওয়া, যে মোহ পাঠককে জীবনের নানা রঙের সাথে পরিচিত করিয়ে দেয় নানা ঢঙে, নানা ছন্দে, নানা সুর ও বর্ণে। তাঁর ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাট্যগ্রন্থ, ১৩টি উপন্যাস, ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসংকলন জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর কিছুদিন পরই আলোর মুখ দেখে। কাবুলিওয়ালা, হৈমন্তী, পোস্টমাস্টারসহ মোট ৯৫টি গল্প স্থান পেয়েছে তাঁর ‘গল্পগুচ্ছ’ গ্রন্থে। অন্যদিকে ‘গীতবিতান’ গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে ১,৯১৫টি গান। উপন্যাস, কবিতা, সঙ্গীত, ছোটগল্প, গীতিনাট্য, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনীসহ সাহিত্যের সকল শাখাই যেন ধারণ করে আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই সমূহ। তিনি একাধারে নাট্যকার ও নাট্যাভিনেতা দুই-ই ছিলেন। কোনো প্রথাগত শিক্ষা ছাড়া তিনি চিত্রাংকনও করতেন। তৎকালীন সমাজ-সংস্কারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন এই গুণী ব্যক্তিত্ব। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাতেই অনূদিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই সমগ্র। তাঁর যাবতীয় রচনা ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’ নামে ত্রিশ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট জোড়াসাঁকোর বাড়িতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর পর এতদিন পেরিয়ে গেলেও তাঁর সাহিত্যকর্ম আজও স্বমহিমায় ভাস্বর। আজও আমাদের বাঙালি জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে বিশ্বকবির সাহিত্যকর্ম।