দখিনের জানালা স্মারকসংকলনের লেখাগুলো সম্পাদনা করতে গিয়ে লক্ষ করেছি শিক্ষাবিদ আলাউদ্দিন আহমেদের প্রায় সমবয়সি তথা সিনিয়র শিক্ষার্থীদের স্মৃতিচারণে তাঁর সংস্কৃতিচর্চার বিষয়টি বেশি উল্লিখিত হলেও পরবর্তী সময়ের লেখকদের লেখায় এই অধ্যায়টি একেবারেই অনুপস্থিত, এর কারণ স্বাধীনতাপূর্ব সময়ে স্কুলে যাত্রা-নাটক আবৃত্তি বিতর্ক প্রতিযোগিতার যে বেগবান ধারা গড়ে ওঠেছিল তা স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে অব্যাহত থাকেনি। এই সংস্কৃতিধারার অন্যতম ধারক ও বাহক আলাউদ্দিন আহমেদ, মৌলবি আবদুস সাত্তার শিক্ষকতায় নিয়োজিত থাকলেও স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে খুব বেশিদূর তা এগিয়ে নিতে পারেননি। এই ব্যর্থতার কারণও আছে। প্রথমত রুচিবান এবং উদার সংস্কৃতিমনা প্রধান শিক্ষক চারুচন্দ্র দাশের বিদায়ের পর প্রধান শিক্ষকের পদটি শূন্য হয়ে গেলে সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে এর দায়িত্ব এসে পড়ে আলাউদ্দিন আহমেদের ওপরে। একদিকে শারীরিক অসুস্থতা তার ওপর ভারপ্রাপ্ত হিসেবে পূর্ণ ক্ষমতা প্রয়োগের অক্ষমতা আবার দায়ভারের ষোলোআনা কাঁধে নিয়ে তখন তাঁর সংস্কৃতিচর্চার প্রেরণাটি চাপা পড়ে যায়। অবশ্য তখন জাতীয় পর্যায়েই সংস্কৃতির ওপর একটি অশুভ কালো পর্দা নেমে এসেছিল। ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত জে কে হাইস্কুলে উৎসবের আমেজে যাত্রা-নাটক ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হয়েছে। চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ এবং পঁচাত্তরের রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের পর স^াধীনতা-উত্তর সেই বিপুল উদ্দীপনা আনন্দ-উৎসব ভিন্নখাতে প্রবাহিত হতে শুরু করে। অনেকেই একে পাকিস্তানিকরণ বলে মনে করেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সেটা পাকিস্তানিকরণ ছিল না। পাকিস্তান আমলে তো বাঙালি সংস্কৃতি অনেকটাই পল্লবিত ছিল। বাধা ছিল, কিন্তু বাধাকে অতিক্রমের মানসিকতা সেই চর্চাকে আরও বেগবান করেছে। সে কারণেই জাতীয় মানসের ওই পট-পরিবর্তনকে পাকিস্তানিকরণ না-বলে আরবিকরণ বলা-ই অধিক স্বস্তিদায়ক। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্যদিয়ে আমাদের সংস্কৃতিজগতে যে অন্ধকার যুগের সূচনা হয়েছিল, সেই যুগের এখন পূর্ণ বিকাশকাল। নবীগঞ্জ জে কে হাইস্কুল তো বিচ্ছিন্ন কোনও দ্বীপ নয়। ধীরে ধীরে এখানেও আঁধার নেমেছে।