নানারূপ গদ্যপদ্য লেখবার এবং ছাপবার যতটা প্রবল ঝোঁক যত বেশি লোকের মধ্যে আজকাল এ দেশে দেখা যায়, তা পূর্বে কখনো দেখা যায় নি। এমন মাস যায় না, যাতে অন্তত একখানি মাসিক পত্রের না আবির্ভাব হয়। এবং সে-সকল মাসিক পত্রে সাহিত্যের সকলরকম মালমসলার কিছু-না-কিছু নমুনা থাকেই থাকে । সুতরাং এ কথা অস্বীকার করবার জো নেই যে, বঙ্গ সাহিত্যের একটি নতুন যুগের সূত্রপাত হয়েছে। এই নবযুগের শিশুসাহিত্য আঁতুড়েই মরবে কিংবা তার একশো বৎসর পরমায়ু হবে, সে কথা বলতে আমি অপারগ। আমার এমন কোনো বিদ্যে নেই, যার জোরে আমি পরের কুষ্ঠি কাটতে পারি। আমরা সমুদ্রপার হতে যে-সকল বিদ্যার আমদানি করেছি, সামুদ্রিক বিদ্যা তার ভিতর পড়ে না। কিন্তু এই নবসাহিত্যের বিশেষ লক্ষণগুলির বিষয় যদি আমাদের স্পষ্ট ধারণা জন্মায়, তা হলে যুগধর্মানুযায়ী সাহিত্যরচনা আমাদের পক্ষে অনেকটা সহজ হয়ে আসবে । পূর্বোক্ত কারণে, নব্য লেখকরা তাঁদের লেখায় যে হাত দেখাচ্ছেন, সেই হাত দেখবার চেষ্টা করাটা একেবারে নিষ্ফল নাও হতে পারে । প্রথমেই চোখে পড়ে যে, এই নবসাহিত্য রাজধর্ম ত্যাগ করে গণধর্ম অবলম্বন করছে। অতীতে অন্য দেশের ন্যায় এ দেশের সাহিত্যজগৎ যখন দু-চারজন লোকের দখলে ছিল, যখন লেখা দূরে থাক্ পড়বার অধিকারও সকলের ছিল না, তখন সাহিত্যরাজ্যে রাজা সামন্ত প্রভৃতি বিরাজ করতেন। এবং তাঁরা কাব্য দর্শন ও ইতিহাসের ক্ষেত্রে, মন্দির অট্টালিকা স্তূপ স্তম্ভ গুহা প্রভৃতি আকারে বহু চিরস্থায়ী কীর্তি রেখে গেছেন। কিন্তু বর্তমান যুগে আমাদের দ্বারা কোনোরূপ প্রকাণ্ড কাণ্ড করে তোলা অসম্ভব এই জ্ঞানটুকু জন্মালে আমাদের কারো আর সাহিত্যে রাজা হবার লোভ থাকবে না । এবং শব্দের কীর্তিস্তম্ভ পড়বার বৃথা চেষ্টায় আমরা দিন ও শরীর পাত করব না । এর জন্য আমাদের কোনোরূপ দুঃখ করবার আবশ্যক নেই। বস্তুজগতের ন্যায় সাহিত্যজগতেরও প্রাচীন কীর্তিগুলি দূর থেকে দেখতে ভালো, কিন্তু নিত্যব্যবহার্য নয় ।
প্রমথ চৌধুরী (৭ আগস্ট ১৮৬৮ — ২ সেপ্টেম্বর ১৯৪৬) বাংলা ভাষার অন্যতম সাহিত্যিক যিনি বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে সক্রিয় ছিলেন। তিনি ছিলেন একাধারে প্রাবন্ধিক, কবি ও ছোটগল্পকার। বীরবল ছদ্মনামও তিনি ব্যবহার করেছেন। তার পৈতৃক নিবাস বর্তমান বাংলাদেশের পাবনা জেলার অন্তর্গত চাটমোহর উপজেলার হরিপুর গ্রামে। তিনি বাংলা গদ্যে চলিত রীতির প্রবর্তক হিসাবে প্রসিদ্ধ। সবুজপত্র পত্রিকা সম্পাদনার মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে চলিতরীতি প্রবর্তন করেন।এছাড়া বাংলা সাহিত্যে প্রথম বিদ্রূপাত্মক প্রবন্ধ রচনা করেন। ছোটগল্প ও সনেট রচনাতেও হিসেবেও তার বিশিষ্ট অবদান রয়েছে। তিনি সবুজপত্র এবং বিশ্বভারতী পত্রিকা সম্পাদনা করেন।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] শিক্ষাজীবন প্রমথ চৌধুরীর শিক্ষাজীবন ছিল অসাধারণ কৃতিত্বপূর্ণ। তিনি কলকাতা হেয়ার স্কুল থেকে এন্ট্রান্স ও সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে এফ এ পাস করেন। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৮৮৯খ্রি বিএ(অনার্স)দর্শন, ১৮৯০সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে প্রথম শ্রেণীতে এমএ ডিগ্রী লাভ করেন এবং পরে ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য বিলাত যান। বিলাত থেকে ফিরে এসে ব্যারিস্টারি পেশায় যোগদান না করে তিনি কিছুকাল ইংরেজি সাহিত্যে অধ্যাপনা করেন এবং পরে সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করেন। ১৯৪১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে 'জগত্তারিণী পদক' লাভ করেন । পারিবারিক ও কর্মজীবন প্রমথ চৌধুরী কিছুদিন কলকাতা হাইকোর্টে আইনব্যবসা করেন। কিছুকাল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন কলেজে পড়িয়েছেন। তিনি ঠাকুর এস্টেটের ম্যানেজার ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের অগ্রজ সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৪২-১৯২৩) কন্যা ইন্দিরা দেবীর (১৮৭৩-১৯৬০) সঙ্গে তার বিয়ে হয়। তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ভাইঝি জামাতা। লেখক আশুতোষ চৌধুরী (১৮৮৮-১৯৪৪) সম্পর্কে প্রমথ চৌধুরীর অগ্রজ। রবীন্দ্রনাথের ভগিনী প্রতিভা দেবীর সহিত আশুতোষ চৌধুরী বিবাহ হয়। প্রবন্ধ সাহিত্যের জন্য তিনি বেশী বিখ্যাত। তার প্রথম প্রবন্ধ জয়দেব প্রকাশিত হয় সাধনা পত্রিকায় ১৮৯৩ সালে। তার সাহিত্যিক ছদ্মনাম ছিল বীরবল। তার সম্পাদিত সবুজ পত্র বাংলা সাহিত্যে চলতি ভাষারীতি প্রবর্তনে আগ্রণী ভূমিকা পালন করে। তার প্রবর্তিত গদ্যরীতিতে “সবুজ পত্র” নামে বিখ্যাত সাহিত্যপত্র ইতিহাসে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। তারই নেতৃত্বে বাংলা সাহিত্যে নতুন গদ্যধারা সূচিত হয়। তিনি বাংলা সাহিত্যে ইতালিয় রূপবন্ধের সনেট লিখেছেন। এছাড়াও তিনি বিশ্বভারতী পত্রিকার সম্পাদনা করেন।