বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্প রচনায় প্রেমেন্দ্র মিত্র অসামান্য অবদান রেখেছেন। ছোটগল্পের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে প্রেমেন্দ্র মিত্রের আবির্ভাব প্রাথমিক পর্যায়ের প্রায় মাঝা-মাঝি সময়ে । বাংলা সাহিত্যে সার্থক ছোটগল্পের উৎপত্তি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতে । রবীন্দ্রনাথের পূর্বেও গল্প লেখার চর্চা পরিলক্ষিত হয়, তবে সেগুলোকে প্রকৃত অর্থে ছোটগল্প বলা চলে না। বঙ্কিমচন্দ্র থেকেই গল্প লেখার চেষ্টা, তাঁর ‘যুগলাঙ্গুরী’ ও ‘রাধারাণী' গ্রন্থের মধ্যে প্রথমবারের মত ছোটগল্পের প্রয়াস লক্ষ্য করা গেলেও আধুনিক ছোটগল্পের সংজ্ঞায় তাকে ছোটগল্প বলা যায় না। আকৃতিতে ছোট হলেও তা উপন্যাসধর্মী । পরবর্তীতে আসে পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ে 'মধুমতি' ও সঞ্জীবচন্দ্রের ‘রামেশ্বরের অদৃষ্ট'। এরপর স্বর্ণকুমারী দেবী, তাঁর লেখা গল্পগ্রন্থের নাম ‘নবকাহিনী'। এরপর নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত, ত্রৈলোক্য নাথ মুখোপাধ্যায় ইত্যাদি। তবে তাঁদের লেখা সংজ্ঞামতে ছোটগল্পের কাছাকাছি পৌঁছালেও সেগুলোকে প্রকৃত অর্থে ছোটগল্প বলা যায় না । বাংলা সাহিত্যে প্রথম সার্থক ও সফল ছোটগল্পকার হচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথের বিপুল প্রতিভার যাদুস্পর্শে বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখাপ্রশাখা বিপুল বেগে সুসমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। এর মধ্যে ছোটগল্প একটি। রবীন্দ্রনাথের পূর্বে ছোটগল্পের সূত্রপাত হলেও তা সার্থকতার স্পর্শ পায়নি। রবীন্দ্রনাথই তাঁর অসামান্য প্রতিভার গুণে প্রথম সার্থক ছোটগল্পকার হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করেন। রবীন্দ্রনাথের পথধরে পরবর্তীতে অসংখ্য লেখক ছোটগল্প রচনায় অনুপ্রাণিত হন এবং সুন্দর সুন্দর ছোটগল্প রচনা করেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছোটগল্পকার হচ্ছেন—প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, মনিলাল গঙ্গোপাধ্যায়, সৌরিন্দ্র মোহন মুখোপাধ্যায়, হেমন্দ্ৰকুমার রায়, দক্ষিণাঞ্জনমিত্র মজুমদার, প্রথম চৌধুরী। প্রমথ চৌধুরীর, রাজশেখর বসু । এরপর বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন এবং তারপরপই প্রেমেন্দ্র মিত্রের আগমন। প্রেমেন্দ্র মিত্রের পর অচিন্তকুর সেনগুপ্ত, বুদ্ধদেব বসু, কাজী নজরুল ইসলাম, শৈলজানন্দ মুখোপাধায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সমথনাথ বিশী ও বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধামের নাম উল্লেখযোগ্য । প্রেমেন্দ্র মিত্র (১৯০৪-১৯৮৮) ত্রিশ দশকের একজন অন্যতম ছোটগল্প লেখক। প্রথম মহাযুদ্ধের পর এদেশে যে অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছিল, দুর্ভিক্ষের কারণে দেশের মানুষের মধ্যে যে সামাজিক ও নৈতিক অধঃপতন ঘটেছিল, সেই বিভৎসতা, লালসার জঘন্য চিত্র, নারীর প্রতি ব্যভিচার, কিছু কিছু লোভী মানুষের হিংসা, কদাকার অহংকার, মানসিক বিকার ও কদর্যতা প্রেমেন্দ্র মিত্রের গল্পের মূল উপাদান হয়ে ওঠে। তাঁর গল্পগ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে— 'বেনামী বন্দর’, ‘পুতুল ও প্রতিমা', ‘অফুরন্ত', 'মহানগর', 'পঞ্চশার', 'ধুলিধূসর', 'কুড়িয়ে ছড়িয়ে', 'সামনে চড়াই', ‘সপ্তপদী', ‘ডাল পায়রা’, ‘প্রেমই ধন্বন্তরী’, ও ‘নানা রঙে বোনা' ইত্যাদি
প্রেমেন্দ্র মিত্র ( জন্ম: ১৯০৪ - মৃত্যু: ৩ মে, ১৯৮৮) একজন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী বাঙালি কবি, ছোটগল্পকার, ঔপন্যাসিক এবং চিত্রপরিচালক। বাংলা সাহিত্যে তাঁর সৃষ্ট জনপ্রিয় চরিত্রগুলি হল ঘনাদা, পরাশর বর্মা, মেজকর্তা এবং মামাবাবু।