মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিক। আধুনিকতার নানা স্বরূপলক্ষণে, মণ্ডিত হয়ে উপন্যাসগুণের নানা বৈশিষ্ট্যে চিহ্নিত হয়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'পুতুল নাচের ইতিকথা' আধুনিক বাংলা সাহিত্যে এক যুগান্তকারী মর্যাদা লাভ করেছে। ১৯৩৬ সালে মানিকের দুখানি উপন্যাস প্রকাশিত হয় 'পুতুল নাচের ইতিকথা' ও 'পদ্মানদীর মাঝি । এই দুখানি উপন্যাস প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক বাংলা সাহিত্যে তাঁর স্থান এক স্বতন্ত্র মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হয়। এই দুটি উপন্যাস মানিকের উপন্যাস-জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি। ঔপন্যাসিক জীবনের রূপকার। জীবনের ও সমাজের নানা সমস্যাকে ঔপন্যাসিক রূপ দেন মধ্যবিত্ত জীবনের সমস্যাকে, গ্রামবাংলার নানা প্রতিকূলোতাকে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর সাহিত্যে রূপ দিয়েছেন। এই দিক থেকে বিচার করলে দেখা যায় উপন্যাসে বাস্তবধর্মিতার যে দাবি অগ্রাধিকার লাভ করে সেই দাবিকে তিনি উপন্যাসে রূপ দিয়েছেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় উপন্যাসে বাস্তবতার প্রতিষ্ঠাতা। এই বাস্তবতার গুণেই ঔপন্যাসিকের মাহাত্ম্য নির্ণীত হয়। ‘পুতুল নাচের ইতিকথা'র বক্তব্য ও আঙ্গিক স্বতন্ত্র। এই উপন্যাসে শশী চরিত্রের মধ্য দিয়ে ঔপন্যাসিক কেবল আধুনিক জীবনের বিচ্ছিন্নতা ও নিঃসঙ্গতাকে ফুটিয়ে তোলেননি, তাকে এক বাস্তবধর্মী রূপ দিয়েছেন। এই উপন্যাসের রচনারীতি, বর্ণনাভঙ্গী, আঙ্গিক বিন্যাস ও ঘটনা সম্পাদনা-বৈশিষ্ট্য, চরিত্রনির্মাণ সবই স্বতন্ত্র মর্যাদা লাভ করেছে। এই দিক থেকে উপন্যাসটি আধুনিকতার লক্ষণাক্রান্ত । 'পুতুল নাচের ইতিকথা'র চরিত্রগুলি সু-অঙ্কিত। কেবল শশী নয়, কুসুম, বিন্দু, মতি, নন্দ, যাদব, গোপাল, কুমুদ সবাই জীবনাভিজ্ঞতার নানা স্তর থেকে আহৃত চরিত্র। প্রত্যেকটি চরিত্রসৃষ্টির মধ্যে ঔপন্যাসিকের জীবনদৃষ্টি ও পর্যবেক্ষণ-নৈপুণ্য চোখে পড়ে। 'পুতুল নাচের ইতিকথা' বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস।
শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম, মধ্যবিত্ত সমাজের কৃত্রিমতা, নিয়তিবাদ ইত্যাদি বিষয়কে লেখার মধ্যে তুলে এনে বাংলা সাহিত্যে যিনি অমর হয়েছেন, তিনি হলেন প্রখ্যাত ভারতীয় বাঙালি কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। খ্যাতিমান এই সাহিত্যিক ১৯০৮ সালের ১৯ মে বিহারের সাঁওতাল পরগনায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রকৃত নাম প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, আর মানিক ছিলো তাঁর ডাকনাম। বাবার বদলির চাকরিসূত্রে তাঁর শৈশব, কৈশোর ও ছাত্রজীবন কেটেছে বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে, যার ফলে বিভিন্ন অঞ্চলের পটভূমিতে বিভিন্ন সাহিত্য রচনা করেছেন তিনি। প্রবেশিকা ও আইএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় গণিত বিষয়ে অনার্স করতে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। এখানে পড়াশোনাকালে বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে তিনি 'অতসী মামী' গল্পটি লেখেন। সেই গল্পটি বিখ্যাত 'বিচিত্রা' পত্রিকায় ছাপানো হলে তা পাঠকনন্দিত হয় এবং তিনি সাহিত্যাঙ্গনে পরিচিত হয়ে ওঠেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি সাহিত্য রচনায় পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন, যার ফলে তাঁর পড়াশোনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এবং তিনি আর পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি। তাঁর হাতে বাংলা সাহিত্যে এক বৈপ্লবিক ধারা সূচিত হয় ঐ সময়ে, যখন সারা পৃথিবী জুড়ে মানবিক বিপর্যয়ের এক চরম সংকটময় মুহূর্ত চলছে। কমিউনিজমের দিকে ঝুঁকে যাওয়ায় তাঁর লেখায় একসময় এর ছাপ পড়ে এবং মার্ক্সীয় শ্রেণীসংগ্রাম তত্ত্ব দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমগ্র। ফ্রয়েডীয় মনোসমীক্ষণেরও প্রভাব লক্ষ্য করা যায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র-তে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমূহ এর মধ্যে 'পদ্মানদীর মাঝি', 'দিবারাত্রির কাব্য', 'পুতুলনাচের ইতিকথা', 'শহরতলি', 'চতুষ্কোণ', 'শহরবাসের ইতিকথা' ইত্যাদি বিখ্যাত উপন্যাস, এবং 'আত্মহত্যার অধিকার', 'হারানের নাতজামাই', 'বৌ', 'প্রাগৈতিহাসিক', 'সমুদ্রের স্বাদ', 'আজ কাল পরশুর গল্প' ইত্যাদি গল্পগ্রন্থ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা রচনার কিছু নিদর্শন থাকলেও সেগুলো তেমন উল্লেখযোগ্যতা অর্জন করেনি। অসামান্য এই কথাসাহিত্যিক মাত্র ৪৮ বছর বয়সে ১৯৫৬ সালের ৩ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।