‘বিষাদ সিন্ধু’ বাংলা সাহিত্যের একটি কালজয়ী উপন্যাস। শুধু কালজয়ীই নয়, বাংলা সাহিত্যে জনপ্রিয় বা বহুলপঠিত উপন্যাসের মধ্যে এটি অগ্রগণ্য। আজ থেকে এক শত ত্রিশ বছরেরও অধিক সময় আগে উপন্যাসটি প্রকাশ হয়। তিনটি পর্বে প্রকাশিত উপন্যাসটির প্রথম খণ্ড (মহররম পর্ব) প্রকাশিত হয় ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে, দ্বিতীয় খণ্ড (এজিদবধ পর্ব) প্রকাশিত হয় ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে এবং তৃতীয় খণ্ড (উদ্ধার পর্ব) প্রকাশিত হয় ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে। প্রকাশের এত বছর পরেও এখন পর্যন্ত বাঙালি পাঠকের কাছে গ্রন্থটি সাদরে গৃহীত হচ্ছে। ‘বিষাদ সিন্ধু’ (প্রথম খণ্ড) প্রকাশের পরপরই কাঙাল হরিনাথ মজুমদার সম্পাদিত ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’-এর ১২৯২ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায় এর যে আলোচনা লেখা হয় তার কিয়দংশের উদ্ধৃতিÑমুসলমানদিগের গ্রন্থ এরূপ বিশুদ্ধ বঙ্গভাষার অল্পই অনূবাদিত ও প্রকাশিত হইয়াছে। এই সকল গ্রন্থ যে বঙ্গভাষার বিস্তৃতির আর একটি নতুন পথ এবং মাতৃভাষা বাংলার প্রতি মুসলমানদিগের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করিতেছে, ইহা চিন্তাশীল পাঠক সহজেই বুঝতে পারেন। ‘বিষাদ সিন্ধু’ প্রকাশের পরপরই গ্রন্থটি নিয়ে পঠন-পাঠন, আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে অনেক। এখনও হচ্ছে এর মূল্যায়ন ও পুনর্মূল্যায়ন। গ্রন্থটি যেমন নন্দিত হয়েছে কারবালার ঐতিহাসিক ও মর্মন্তুদ ঘটনা অবতারণা এবং সৃষ্টিশীল গদ্য রচনার জন্য, তেমনি নিন্দিত হয়েছে ঐতিহাসিক তথ্য অবমাননা ও অলৌকিক কাহিনির অবতারণার দায়ে। এ দ্বিবিধ গুণ ও দোষের পরেও কেন বিষাদ-সিন্ধু এখনও জনপ্রিয়- সেটাই বিচার্য বিষয়। কারবালার বিষাদময় ঘটনা নিয়ে লেখা উপন্যাস বিষাদ-সিন্ধু তার শ্রেষ্ঠ রচনা। তার সৃষ্টিকর্ম বাংলার মুসলমান সমাজে আধুনিক সাহিত্যধারার সূচনা করে।
(নভেম্বর ১৩, ১৮৪৭ - ১৯১২) ছিলেন একজন বাঙালি ঔপন্যাসিক, নাট্যকার ও প্রাবন্ধিক যিনি ঊনবিংশ শতাব্দাীর দ্বিতীয়ার্ধে বাংলা গদ্যের ঊণ্মেষকালে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন। তিনি বিষাদ সিন্ধু নামক ঐতিহাসিক রচনার জন্য সপুরিচিত ও সাধারণ্যে জনপ্রিয়। তিনি তৎকালীন বৃটিশ ভারতে (বর্তমান বাংলাদেশ) কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালি উপজেলার চাঁপড়া ইউনিয়নের লাহিনীপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর লেখাপড়ার জীবন কাটে প্রথমে কুষ্টিয়ায়, পরে ফরিদপুরের পদমদীতে ও শেষে কৃষ্ণনগরের বিভিন্ন বিদ্যালয়ে। তাঁর জীবনের অধিকাংশ সময় ব্যয় হয় ফরিদপুরের নবাব এস্টেটে চাকরি করে। তিনি কিছুকাল কলকাতায় বসবাস করেন। মীর মশাররফ হোসেন তাঁর বহুমুখী প্রতিভার মাধ্যমে উপন্যাস, নাটক, প্রহসন, কাব্য ও প্রবন্ধ রচনা করে আধুনিক যুগে মুসলিম রচিত বাংলা সাহিত্যে সমৃদ্ধ ধারার প্রবর্তন করেন। সাহিত্যরস সমৃদ্ধ গ্রন্থ রচনায় তিনি বিশেষ কৃতিত্ব দেখান। কারবালার বিষাদময় ঘটনা নিয়ে লেখা উপন্যাস "বিষাদসিন্ধু" তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনা। তাঁর সৃষ্টিকর্ম বাংলার মুসলমান সমাজে আধুনিক সাহিত্য ধারার সূচনা করে। মীর মশাররফ হোসেন খুলনা বিভাগের কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালীর একটি ছোট গ্রাম লাহিনিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু তার জীবনের অধিকাংশ সময় তিনি রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দির পদমদীতে অতিবাহিত করেন। তবে তার জন্ম তারিখ ১৮৪৭ সালের ১৩ নভেম্বর বলে ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়। কিন্তু কিছু গবেষক তার জন্ম তারিখ ১৮৪৭ সালের ২৬ অক্টোবর বলে দাবী করেন। তিনি মীর মোয়াজ্জেম হোসেন (মুসলিম সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি) এবং দৌলতুন্নেছার ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র আঠার বছরে বয়সে তারঁ পিতৃবন্ধুর কন্যা আজিজুন্নেসার সাথে বিয়ে হয়। ১৯১২ সালে দেলদুয়ার এস্টেটে ম্যানেজার থাকাকালেই মীর মশাররফ হোসেন পরলোকগমন করেন। তাকে পদমদীতে দাফন করা হয়।