বাংলা সাহিত্যের এক বিস্ময়কর প্রতিভার নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১)। বাংলা সাহিত্যের এমন কোন শাখা নেই, যা রবীন্দ্রনাথের জাদুকরী হাতের স্পর্শে সমৃদ্ধ হয় নি । কলকাতার বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে আধুনিক কালের এই শ্রেষ্ঠ প্রতিভার জন্ম হয় । কবিতা, সংগীত ছোট গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, রসরচনা, ভ্রমণ কাহিনী প্রভৃতি শাখায় তাঁর সাহিত্য প্রতিভা ব্যাপক বিস্তার লাভ করে। উনিশ শতকের শুরু থেকেই রবীন্দ্রনাথের নাম ছড়াতে থাকে। কারণ এ সময়ের মধ্যেই তাঁর কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ, উপন্যাস, নাটক ও প্রবন্ধগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল।। যাতে তাঁর প্রতিভার অবিনশ্বর স্বাক্ষর আছে। তবু উনিশ শতকের শেষাংশে বঙ্কিমচন্দ্র সীমাবন্দ সম্রাট বলেই স্বীকৃত হয়েছিল। তখন নবযুবক রবীন্দ্রনাথের সারস্বত খ্যাতি অপেক্ষাকৃত সীমাবন্দ ক্ষেত্রেই প্রচারিত হয়েছিল। দেখা যাচ্ছে রবীন্দ্রনাথের ‘সন্ধ্যাসঙ্গীত' (১৮৮২) থেকে চৈতালী' (১৮৯৬), কাব্য ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ' (১৮৮৪) থেকে ‘মালিনী' (১৮৯৬) প্রভৃতি নাটক এবং ‘বউ ঠাকুররানীর হাট' (১৮৮৩) ও ‘রাজর্ষি' (১৮৮৭) উপন্যাস দুটি উনিশ শতকের শেষ ভাগে প্রকাশিত হয়েছিল। বলতে গেলে এর দ্বারাই তাঁর প্রতিভার ব্যাপকতা ও গভীরতা সহজেই ধরা পড়ে। তবু উনিশ শতকে বঙ্গিমচন্দ্রের প্রভাব এতই অনপনেয় ছিল যে, অন্য কারো প্রভাব সেখানে কোনো রকম ছায়াপাত করতে পারেনি । রবীন্দ্রনাথের যথার্থ জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায় নোবেল পুরস্কার লাভে (১৯১৩) পর, এবং বাংলা সাহিত্য বাঙালি সাহিত্যকদের ওপর তাঁর প্রভাবের সুচনাও এ সময় থেকে বিপুলভাবে শুরু হয়। তাঁর এই প্রভাব তাঁর তিরোধানের পরেও অক্ষুণ্ণ রয়েছে এবং সম্ভবত আরো দীর্ঘকাল থাকবে। এ সময়ের মধ্যে তাঁর সাহিত্য ভান্ডারে জমা হয় বিপুল পরিমাণ কবিতা আর সংগীত। তাঁর বহু উৎকৃষ্ট কবিতার সংগীতের মর্যাদা পেয়েছে। পণ্ডিতেরা বলেন, যেকোনো উৎকৃষ্ট কবিতাই সংগীত হিসেবে গীত হতে পারে। রবীন্দ্রনাথের বেলায় তাই হয়েছে। তাঁর এসব সঙ্গীত একত্রে সংকলিত হয়েছে ‘গীতবিতান' গ্রন্থে । রবীন্দ্রনাথের অনেক কাব্যনাট্য, নাট্যকাব্য এবং রঙ্গনাট্য রয়েছে। এগুলোর অধিকাংশই সংগীতের আদলে রচিত। তাই এ জাতীয় বেশ কয়েকটি গ্রন্থ গীতবিতান এর অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। যাতে লিরিক আবেগ নাটকীয় ঘটনার বিকাশ এবং গীতিধর্ম মিশে গিয়ে এক ধরনের বিচিত্র সংগীতরস সৃষ্টি করেছে। কৈশোর ও যৌবনের রুদ্রচণ্ড’ এবং ‘বাল্মীকি প্রতিভা’, ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’, ‘মায়ার খেলা’ এবং পরিপক্ক জীবনে ‘চিত্রাঙ্গদা' নাট্যধৰ্মী কাব্য, কখনো কাব্যধর্মী নাটক, কখনো বা গীতিনাট্য রচনা করেছেন। ‘বাল্মীকি প্রতিভা' 'মায়ার খেলা' বিশুদ্ধ গীতিনাট্য, নাটকের অধারে সংগীত পরিবেশই এর মূল লক্ষ্য। সঙ্গত কারণে এগুলো ‘গীতবিতান' এর অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। রবীন্দ্র সংগীত বিচিত্র বিষয় নিয়ে রচিত । বিষয়- বৈচিত্র্য অনুসারে ‘গীতবিতান' সাজানো হয়েছে। যেমন: পূজা, স্বদেশ, প্রেম, প্রকৃতি, বিচিত্র, আনুষ্ঠানিক ইত্যাদি। আবার গীতিনাট্য ও নৃত্যনাট্য বিষয়ক- বাল্মীকি প্রতিভা, মায়ার খেলা, চিত্রাঙ্গদা, চণ্ডালিকা, শ্যাম, পুজা ও প্রার্থনা, প্রেম ও প্রকৃতি এবং পরিশিষ্ট। এসব অংশে সংকলিত অন্তর মম বিকশিত করো অন্তরতর হে, অন্ধজানে দেহো আলো, মৃতজনে দেহো প্ৰাণ,
প্রমথ চৌধুরী (৭ আগস্ট ১৮৬৮ — ২ সেপ্টেম্বর ১৯৪৬) বাংলা ভাষার অন্যতম সাহিত্যিক যিনি বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে সক্রিয় ছিলেন। তিনি ছিলেন একাধারে প্রাবন্ধিক, কবি ও ছোটগল্পকার। বীরবল ছদ্মনামও তিনি ব্যবহার করেছেন। তার পৈতৃক নিবাস বর্তমান বাংলাদেশের পাবনা জেলার অন্তর্গত চাটমোহর উপজেলার হরিপুর গ্রামে। তিনি বাংলা গদ্যে চলিত রীতির প্রবর্তক হিসাবে প্রসিদ্ধ। সবুজপত্র পত্রিকা সম্পাদনার মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে চলিতরীতি প্রবর্তন করেন।এছাড়া বাংলা সাহিত্যে প্রথম বিদ্রূপাত্মক প্রবন্ধ রচনা করেন। ছোটগল্প ও সনেট রচনাতেও হিসেবেও তার বিশিষ্ট অবদান রয়েছে। তিনি সবুজপত্র এবং বিশ্বভারতী পত্রিকা সম্পাদনা করেন।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] শিক্ষাজীবন প্রমথ চৌধুরীর শিক্ষাজীবন ছিল অসাধারণ কৃতিত্বপূর্ণ। তিনি কলকাতা হেয়ার স্কুল থেকে এন্ট্রান্স ও সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে এফ এ পাস করেন। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৮৮৯খ্রি বিএ(অনার্স)দর্শন, ১৮৯০সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে প্রথম শ্রেণীতে এমএ ডিগ্রী লাভ করেন এবং পরে ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য বিলাত যান। বিলাত থেকে ফিরে এসে ব্যারিস্টারি পেশায় যোগদান না করে তিনি কিছুকাল ইংরেজি সাহিত্যে অধ্যাপনা করেন এবং পরে সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করেন। ১৯৪১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে 'জগত্তারিণী পদক' লাভ করেন । পারিবারিক ও কর্মজীবন প্রমথ চৌধুরী কিছুদিন কলকাতা হাইকোর্টে আইনব্যবসা করেন। কিছুকাল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন কলেজে পড়িয়েছেন। তিনি ঠাকুর এস্টেটের ম্যানেজার ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের অগ্রজ সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৪২-১৯২৩) কন্যা ইন্দিরা দেবীর (১৮৭৩-১৯৬০) সঙ্গে তার বিয়ে হয়। তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ভাইঝি জামাতা। লেখক আশুতোষ চৌধুরী (১৮৮৮-১৯৪৪) সম্পর্কে প্রমথ চৌধুরীর অগ্রজ। রবীন্দ্রনাথের ভগিনী প্রতিভা দেবীর সহিত আশুতোষ চৌধুরী বিবাহ হয়। প্রবন্ধ সাহিত্যের জন্য তিনি বেশী বিখ্যাত। তার প্রথম প্রবন্ধ জয়দেব প্রকাশিত হয় সাধনা পত্রিকায় ১৮৯৩ সালে। তার সাহিত্যিক ছদ্মনাম ছিল বীরবল। তার সম্পাদিত সবুজ পত্র বাংলা সাহিত্যে চলতি ভাষারীতি প্রবর্তনে আগ্রণী ভূমিকা পালন করে। তার প্রবর্তিত গদ্যরীতিতে “সবুজ পত্র” নামে বিখ্যাত সাহিত্যপত্র ইতিহাসে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। তারই নেতৃত্বে বাংলা সাহিত্যে নতুন গদ্যধারা সূচিত হয়। তিনি বাংলা সাহিত্যে ইতালিয় রূপবন্ধের সনেট লিখেছেন। এছাড়াও তিনি বিশ্বভারতী পত্রিকার সম্পাদনা করেন।