মাসিক পত্রিকায় ১৮৫৫ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ১৮৫৭ সালের জুন পর্যন্ত ‘আলালের ঘরের দুলালে’র ২০টি অধ্যায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। সম্পূূর্ণীকৃত রচনাটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৮৫৮ সালে। ১৮২১ সাল থেকে বাংলায় আখ্যান ও নকশা প্রকাশিত হয়ে আসছে। ১৮৫২ সালে প্রকাশিত হানা কাথেরীন ম্যলেন্সের ফুলমণি ও করুণার বিবরণে উপন্যাস রচনার প্রয়াস আছে। কিন্তু আলালের ঘরের দুলালই প্রথম উপন্যাসপদবাচ্য। তবে অনেকেই একে উপন্যাস বলতে কুণ্ঠিত হন। কাহিনির ধারাবাহিকতা, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের বাস্তব চিত্রাঙ্কণ এবং চরিত্রচিত্রণের দক্ষতা বিবেচনা করে একে উপন্যাসই বলতে হয়। নকশার রীতি এর ওপর প্রভাববিস্তার করেছে। তাই এর চরিত্রগুলি সাদা অথবা কালো রঙ্গে চিত্রিত-সেখানে ধূসরের কোনো স্থান নেই। আলালের ঘরের দুলালের প্রশংসা যাঁরা করেছেন, তাঁরা সকলেই এর দুটি গুণের কথা বলেছেন-এর ভাষা ও বিষয়বস্তুর দুইই ঘরের থেকে নেওয়া। বঙ্কিমচন্দ্রের কথায়, যে ভাষা সকল বাঙ্গালির বোধগম্য এবং সকল বাঙ্গালি কর্ত্তৃক ব্যবহৃত, প্রথম তিনিই তাহা গ্রন্থপ্রণয়নে ব্যবহার করিলেন।... আর তাঁহার দ্বিতীয় অক্ষয় কীর্ত্তি এই যে, তিনিই প্রথম দেখাইলেন যে, সাহিত্যের প্রকৃত উপাদান আমাদের ঘরেই আছে,Ñতাহার জন্য ইংরাজি বা সাংস্কৃতের কাছে ভিক্ষা চাহিতে হয় না। ... প্রকৃত পক্ষে আমাদের জাতীয় সাহিত্যের আদি “আলালের ঘরের দুলাল”।
প্যারীচাঁদ মিত্র কলকাতায় ১৮১৪ সালের ২২শে জুলাই এক বণিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম রামনারায়ণ মিত্র। তিনি কাগজ ও হুন্ডি ব্যবসায়ী ছিলেন। প্যারীচাঁদ মিত্র বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। শৈশবে একজন গুরুমহাশয়ের নিকট বাংলা, পরে একজন মুনশির নিকট ফারসি শিখেন। ইংরেজি লাভের জন্য হিন্দু কলেজে একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছিলেন। ঐ সময় ডিরোজিও নামে একজন বিখ্যাত অধ্যাপক ছিলেন হিন্দু কলেজে। তিনি তাঁর শিষ্য ও ভাবশিষ্য ছিলেন। তিনি বাংলার নবজাগরণের অন্যতম নেতা ছিলেন। তিনি ক্যালকাটা পাবলিক লাইব্রেরির লাইব্রেরিয়ান ছিলেন। তিনি ফার্সি, বাংলা ও ইংরেজি ভালো জানতেন। বিশেষ করে বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় বহু গ্রন্থ রচনা করে তিনি খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তিনি মহিলাদের জন্য একটি মাসিক পত্রিকা সম্পাদনা করেন। তাঁর সহযোগী ছিলো রাধানাথ শিকদার। তিনি এছাড়াও জনকল্যাণ মূলক কাজও করতেন। তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটের সদস্য ছিলেন। তিনি পশু-ক্লেশ নিবারণী সভারও সদস্য ছিলেন। বেথুন সোসাইটি ও ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটির অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন প্যারীচাঁদ মিত্র। জ্ঞানান্বেষণ সভার সদস্য হন তিনি ১৮৩৮ সালে। তাঁর ইংরেজি ভাষায় রচিত লেখাসমূহ ছাপা হত ইংলিশম্যান, ইন্ডিয়ান ফিল্ড, ক্যালকাটা রিভিউ, হিন্দু প্যাট্রিয়ট, ফ্রেন্ড অফ ইন্ডিয়া প্রভৃতি পত্রিকায়। তিনি পুলিশি অত্যাচারিতার বিরুদ্ধে লড়েছিলেন এবং সফলকামও হয়েছিলেন। তিনি স্ত্রী শিক্ষা প্রচারে যথেষ্ট সক্রিয়তার পরিচয় দেন। তিনি বিধবাবিবাহ সমর্থন করতেন। তিনি বাল্যবিবাহ এবং বহুবিবাহের বিরোধিতা করেন। তিনি আমদানি ও রফতানি এবং চালের ব্যবসা করে প্রচুর অর্থোপার্জন করেন। আলালের ঘরের দুলাল (তাঁর শ্রেষ্ঠ এবং বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস)। ১৮৫৮ খ্রি. প্রকাশিত এই উপন্যাসটির অন্যতম প্রধান চরিত্র ঠকচাচা । উল্লেখ্য যে এখানে তিনি যে কথ্য ভাষা ব্যবহার করেছিলেন তা আলালী ভাষা নামে পরিচিতি লাভ করেছে। এই গ্রন্থটি ইংরেজিতেও অনুবাদ করা হয়েছিল The spoiled child নামে। ১৮৮৩ সালের ২৩শে নভেম্বর তিনি কলকাতায় মারা যান।