জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪) প্রধানত আধুনিক জীবনচেতনা ও বাংলার প্রকৃতির রূপবৈচিত্র্যে নিমগ্নচিত্ত কবি ও লেখক । লেখকের দৃষ্টিতে বাংলাদেশ এক অনন্য রূপসী। এ দেশের গাছপালা, লতাগুল্ম, ফুল-পাখি তাঁর আজন্ম প্রিয়। জীবনানন্দ দাশ বিশুদ্ধ প্রকৃতিপ্রেমিক লেখক ও কবি। ‘রূপসী বাংলা' তাঁর শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ। ‘জীবনানন্দ দাশের উপন্যাসসমগ্র' আলোচনায় যাওয়ার আগে কবির জীবনকথা সম্পর্কে কিছু বলা প্রয়োজন । বরিশাল শহরে ব্রাহ্ম পরিবারে জীবনানন্দ দাশের জন্ম। আদি নিবাস বিক্রমপুরের গাওপাড়া গ্রামে । পিতা সত্যানন্দ দাশ বরিশাল ব্রজমোহন স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন । জীবনানন্দ দাশ বরিশাল ব্রজমোহন স্কুল থেকে ১৯১৫ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক ও বরিশাল ব্রজমোহন কলেজ থেকে ১৯১৭ সালে প্রথম বিভাগে আই. এ পাস করেন। তারপর ভর্তি হন কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে। এই কলেজ থেকে ১৯১৯ সালে ইংরেজিতে বি. এ অনা i এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯২১ সালে ইংরেজিতে দ্বিতীয় শ্রেণিতে এম. এ ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯২২ সালে কলকাতার সিটি কলেজে ইংরেজি সাহিত্য বিভাগে ‘টিউটর' পদে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। সে সময় তিনি হ্যারিসন রোডের প্রেসিডেন্সি বোর্ডিং-এ থাকতেন। এরপর কিছুদিনের জন্যে বেচু চ্যাটার্জি স্ট্রিটে একটা ঘর ভাড়া নিলেন । বরিশাল থেকে তাঁর ভাই অশোকানন্দ গণিতে এম. এসসি পড়ার জন্যে কলকাতায় যান । তখন দুভাই একসঙ্গে থাকতেন। এক বছরের মধ্যে কয়েকবার বাসস্থান পরিবর্তন করেন। তখনো পর্যন্ত 'ব্রহ্মবাদী' পত্রিকায় তাঁর একমাত্র 'বর্ষ-আবাহন' নামে কবিতাটিই মুদ্রিত হয়েছে। জীবনানন্দ দাশ সিটি কলেজ থেকে ১৯২৯ সালে বাগেরহাট কলেজে যোগ দেন। তারপর দিল্লির রামযশ কলেজে (১৯২৯-১৯৩০) অধ্যাপনা করেন। ১৯৩০ সালে তিনি ঢাকার লাবণ্য গুপ্তের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। মাঝখানে কিছুদিন বেকার জীবনযাপনের পর ১৯৩৫ সালে বরিশাল ব্রজমোহন কলেজে অধ্যাপনায় যোগ দেন । ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত এই কলেজে অধ্যাপনার পর কলকাতায় যান। সেখানে তিনি 'দৈনিক স্বরাজ' পত্রিকার সাহিত্য বিভাগ সম্পাদনা করেন। ১৯৫১-১৯৫২ সালে খগড়পুর কলেজে, ১৯৫২-তে বড়িয়া কলেজে ও ১৯৫৩ থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত হাওড়া গার্লস কলেজে অধ্যাপনা করেন। কাব্যসাধনার প্রথম পর্যায়ে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ইসলাম ও সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের দ্বারা প্রভাবিত হলেও জীবনানন্দ দাশ তাঁর পরিণত রচনায় নিঃসংশয় মৌলিকতার পরিচয় দেন। অচিরেই তিনি আধুনিক বাংলা সাহিত্যে একজন প্রধান কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। গ্রামবাংলার ঐতিহ্যময় প্রকৃতি তাঁর কাব্যে রূপময় হয়ে উঠেছে। আধুনিক নাগরিক জীবনের হতাশা, নিঃসঙ্গতা, বিষাদ ও সংশয়ের চিত্র তাঁর কবিতায় দীপ্যমান।
জন্ম-(ফেব্রুয়ারি ১৮, ১৮৯৯ - বঙ্গাব্দ ফাল্গুন ৬, ১৩০৫ - কার্তিক ৫, ১৩৬১) ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান আধুনিক বাঙালি কবি, লেখক, প্রাবন্ধিক এবং অধ্যাপক। তাকে বাংলাভাষার "শুদ্ধতম কবি" বলে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। তিনি বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃতদের মধ্যে অগ্রগণ্য। মৃত্যুর পর থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর শেষ ধাপে তিনি জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেন এবং ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে যখন তার জন্মশতবার্ষিকী পালিত হচ্ছিল ততদিনে তিনি বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয়তম কবিতে পরিণত হয়েছেন। তিনি প্রধানত কবি হলেও বেশ কিছু প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনা ও প্রকাশ করেছেন। তবে ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে অকাল মৃত্যুর আগে তিনি নিভৃতে ২১টি উপন্যাস এবং ১০৮টি ছোটগল্প রচনা গ্রন্থ করেছেন যার একটিও তিনি জীবদ্দশায় প্রকাশ করেননি। তাঁর জীবন কেটেছে চরম দারিদ্রের মধ্যে। বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধকাল অনপনেয়ভাবে বাংলা কবিতায় তাঁর প্রভাব মুদ্রিত হয়েছে। রবীন্দ্র-পরবর্তীকালে বাংলা ভাষার প্রধান কবি হিসাবে তিনি সর্বসাধারণ্যে স্বীকৃত। তাকে বাংলাভাষার শুদ্ধতম কবি অভিধায় আখ্যায়িত করা হয়েছে। তিনি (অক্টোবর ২২, ১৯৫৪ -বঙ্গাব্দ কার্তিক ৫, ১৩৬১ ) সালে মৃত্যু বরণ করেন।