আমি আলবদর ছিলাম। একাত্তরের সিদ্ধান্ত আমার নিজস্ব। আমার বিবেকের সাথে পরামর্শ করে এ সিদ্ধান্ত আমি নিয়েছিলাম। কোন দল কোন গোষ্ঠী অথবা কোন ব্যক্তি এ সিদ্ধান্ত আমার ওপর চাপিয়ে দেয়নি। আবেগ দ্বারা তাড়িত হয়ে অথবা কোন কিছুতে প্রলুব্ধ হয়ে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম একথা সত্য নয়। বন্দুকের নলের মুখে এ সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছি তাও নয়। ২শ’ বছরের গোলামীর ইতিহাস, সমসাময়িক হিন্দু চক্রান্ত, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের অতীত কার্যকলাপ, তথাকথিত সমাজতন্ত্রীদের দুরভিসন্ধি সব মিলে ২৫শে মার্চের পর আমার বিবেকে একটা ঝড়ো হাওয়া বইতে থাকে। আমার তারুণ্যকে পরিস্থিতির সুলভ শিকারে পরিণত হতে মন সায় দেয়নি। বার বার মনকে প্রশ্ন করেছি: এদেশে ইট কাঠ দালানগুলো ও অন্যান্য জড় পদার্থের মত আমি নীরব দর্শক হয়ে বোবার মত দাঁড়িয়ে থাকব? এই আত্মঘাতী ষড়যন্ত্রের শেষ কোথায়? যে হিন্দুস্তান তার নিজের দেশে হাজার হাজার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সৃষ্টি করে মুসলমানদের নিধন করছে, সেই ভারত কী স্বার্থে পূর্ব-পাকিস্তানের আট কোটি মুসলমানদের জন্য দরদে উচ্ছসিত হয়ে উঠল? আওয়ামী লীগের তৎকালীন ধ্বংসাত্মক তৎপরতা ৫৪ হাজার বর্গমাইল একটি ভূখণ্ডকে সেই দেশের মানুষকে দিয়ে পদানত করার ভারতীয় প্রয়াস বলে আমার ধারণা হল। মনে হল এদেশের ৮ কোটি মুসলমানকে দিল্লীর আজ্ঞাবহ সেবাদাসে পরিণত করতে চায় আওয়ামী লীগ। ইসলামী জজবাতের ঘুমন্ত সত্তা আমার মধ্যে জেগে উঠল। আমি সবকিছু জেনে শুনে সিদ্ধান্ত নিলাম। আমার পিতা অথবা পিতামহদের আশা-আকাক্সক্ষা ছেচল্লিশের গণরায়ের সপক্ষে হাতিয়ার তুলে নিলাম। সক্রিয় অংশ নিলাম প্রতিরোধ লড়াই-এ। তারপর রুশ-ভারত অক্ষশক্তির সব ষড়যন্ত্রের শেষ পরিণতি হল ১৬ই ডিসেম্বর। চূড়ান্ত বিপর্যয় হল। বিচ্ছিন্ন হল দেশ। এক ভয়ঙ্কর বিভ্রান্তির গণজোয়ারকে বালির বাঁধ দিয়ে ঠেকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছি, পারিনি। দেশের প্রত্যেকটি জনপদ রাজপথ গ্রাম আর গঞ্জে দেশপ্রেমিক মানুষগুলো লাঞ্ছিত রক্তাক্ত হল। মীরমদনরা নিক্ষিপ্ত হল মীরজাফরের কারাগারে। আমিও কারা প্রকোষ্ঠে অন্তরীণ হলাম। আমার ৪০ বছর কারাদণ্ড হল। আমি দেখেছি বিচারক নিজেই ছিলেন আমার চেয়ে অসহায়।