‘কোনও দিন এরকমও হয়’ বইয়ের ফ্ল্যাপ কথা: প্রণবেশ পেনশন তুলতে গিয়ে ব্যাঙ্কেই খোয়ালেন তাঁর পেনশনের চোদ্দো হাজার টাকা। থানায় ডায়েরি করলেন তিনি। ঘটনাচক্রে তাঁর এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর ছেলে অয়ন সেই থানার ওসি। এদিকে নতুন গড়ে ওঠা হাইরাইজের পাশাপাশি বস্তির লাগোয়া অঞ্চলে চোর-পুলিশ, সাধু-অসাধুর মিশেলে এক মিশ্র পরিবেশে বেড়ে ওঠা শৈশবেই অনাথ পল্লব চট্টরাজ বা প্যালা সেই পরিবেশের শিকার। পুলিশের ছদ্ম সন্দেহের তির প্যালাকেই বিদ্ধ করল কিন্তু প্ৰণবেশের অন্তদৃষ্টিতে ধরা পড়ে নিম্পাপ প্যালার চরিত্রের অন্যদিক। পাড়ার শান্তি কমিটির মিটিং-এ তিনি হঠাৎই শনাক্ত করতে পারলেন তাঁর ছিনতাইকারীকে। তাকে অনুসরণ করতে গিয়ে এক নিরেট দেওয়ালের মুখোমুখি হন প্ৰণবেশ। যে-দেওয়াল তাঁর বিবেকেরও। আজীবন অসদাচারী প্ৰণবেশ সেই অপরাধীর মধ্যে দেখতে পান নিজেকে। তারপর? কাকে ক্ষমা করবেন তিনি? ওয়েলিংটনের কাছে এক চার্চের রেলিং ঘেঁষে পড়েছিল একটা নীলাভ আলোর আভা। রুদ্র নিচু হয়ে দেখল ওটা ছোট্ট মোবাইল ফোন। রিংটোন শোনা যাচ্ছিল অনেকক্ষণ ধরে। আবারও বাজছে সেলফোনটা। বন্ধু দীপুর সঙ্গে পরামর্শ করে মুঠোভরে মোবাইলটা কুড়িয়ে নিয়ে কলটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ঝাঁঝালো গলায় বলে উঠল একটি মেয়ে, ‘আর ইউ দেয়ার বেদা?’ কে এই বেদা? কী তার পরিচয়? সেলফোনটা রুদ্র নিজের কাছে রেখে বুঝতে পারল বেদার জগৎ তার চেয়ে অনেক অনেক বড়। বেদা হয়তো গোলমেলে মানুষ। এই উপন্যাসের প্রথম পর্ব থেকেই শুরু হয়েছে এমনতর জীবনরহস্যের প্রবাহ। এসেছে অনেক চরিত্র- অনাবাসী শ্রমণ, দীপু, দীপুর বউদি শান্তিলতা, দাদা শুভঙ্কর, নিতু, রুণা, বিষাণ এবং আরও অনেকে। সব কটি চরিত্রই চলমান। যদিও সবাই যে কোথাও পৌঁছাচ্ছে, এমন নয়। কেউ কেউ আপন্ন, কেউ সম্মোহিত। জীবনের মায়াজাল আর ম্যাজিক সবার জীবনজুড়ে। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের জাদু-কলমে গাথা দুটি ভিন্নস্বাদের কাহিনী এই বইয়ে।
পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় ১৯৩৫ সালের ২রা নভেম্বর বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের টালমাটাল সময়ে পরিবারসমেত কলকাতা পাড়ি জমান। বাবার চাকরির সুবাদে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় শৈশব কেটেছে তার। কোচবিহার বোর্ডিং স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করেন তিনি। মাধ্যমিক পাস করেন কোচবিহার ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে। পরে কলকাতা কলেজ থেকে বিএ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। শীর্ষেন্দু তার পেশাজীবন শুরু করেন শিক্ষকতার মাধ্যমে। দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকায় সাংবাদিকতাও করেছেন কিছুদিন। বর্তমানে সাহিত্য পত্রিকা দেশ-এর সহকারী সম্পাদক পদে নিয়োজিত আছেন। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় ছোটবেলা থেকেই ভীষণ বইপড়ুয়া ছিলেন। হাতের কাছে যা পেতেন তা-ই পড়তেন। খুব ছোটবেলাতেই তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মানিক বন্দোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, তারাশংকর বন্দোপাধ্যায় এর মতো লেখকদের রচনাবলী পড়ে শেষ করেছেন। এই পড়ার অভ্যাসই তার লেখক সত্ত্বাকে জাগিয়ে তোলে। ১৯৫৯ সালে দেশ পত্রিকায় তার প্রথম গল্প ‘জলতরঙ্গ’ প্রকাশিত হয়। দীর্ঘ ৭ বছর পর দেশ পত্রিকাতেই প্রকাশিত হয় তার প্রথম উপন্যাস ‘ঘুণপোকা’। এরপর থেকেই নিয়মিত লিখতে থাকেন তিনি। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এর বই এর সংখ্যা দু’শতাধিক। তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস পার্থিব, দূরবীন, মানবজমিন, গয়নার বাক্স, যাও পাখি, পারাপার ইত্যাদি। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এর রহস্য সমগ্র রহস্যপ্রেমীদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। প্রায় ৪০ এর অধিক রহস্য গল্প প্রকাশিত হয়েছে ‘অদ্ভুতুরে সিরিজ’ নামকরণে। মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি, ভুতুড়ে ঘড়ি, হেতমগড়ের গুপ্তধন, নন্দীবাড়ির শাঁখ, ছায়াময় ইত্যাদি এই সিরিজের অন্তর্ভুক্ত। এছাড়াও তিনি বেশ কিছু ছোটগল্প রচনা করেছেন। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এর বই সমূহ দুই বাংলায় পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে সমানতালে। এছাড়াও শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এর বই সমগ্র অবলম্বনে বিভিন্ন সময় চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। তার উপন্যাস ‘যাও পাখি’ এবং ‘মানবজমিন’ নিয়ে বাংলাদেশেও ধারাবাহিক নাটক নির্মিত হয়েছে। তার সৃষ্ট চরিত্র শাবর দাশগুপ্ত এবং ধ্রুব পাঠক হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে। সাহিত্যে অবদানের জন্য অনেক পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। শিশু-কিশোরদের জন্য লেখা উপন্যাস ‘মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি’র জন্য ১৯৮৫ সালে ‘বিদ্যাসাগর পুরস্কার’ পান। ১৯৭৩ এবং ১৯৯০ সালে পেয়েছেন ‘আনন্দ পুরস্কার'। ১৯৮৮ সালে ‘মানবজমিন’ উপন্যাসের জন্য অর্জন করেন ‘সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার’। এছাড়াও, ২০১২ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রদত্ত সম্মান ‘বঙ্গবিভূষণ’ লাভ করেন তিনি।