"চক্র" বইয়ের ফ্ল্যাপের লেখা: স্বচ্ছ স্পর্শাতুর ভাষায় জীবনরহস্যের পর্বগুলি। উন্মােচিত হয় শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায়ের কলমে। এক সুবিস্তৃত পটভূমিতে রচিত ‘চক্র’ উপন্যাস লেখকের এই স্বাতন্ত্রচিহ্নিত বৈশিষ্ট্যের এক উজ্জ্বল ধারক। এই উপন্যাসের পটভূমিতে আছে বর্ধমান শহরের কাছে অবস্থিত একটি গ্রাম আর শহর কলকাতা। ভিন্ন স্থান হওয়া সত্ত্বেও দুই জায়গার মধ্যে একটি সংযােগ কোথাও আছে। আর এই সংযােগের মূলে অমল রায়। অমলের ছেলেবেলা কেটেছে এই গ্রামে। পরীক্ষায় ভাল ফল করার পর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। অমলের বাল্য প্রেমিকা পারুল। সেও এই গ্রামের মেয়ে। তার ব্যক্তিত্ব অন্যদের চর্চার বিষয়। অমলের সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়ার পর, শুধুমাত্র প্রেমিকের কামুকতার আঘাতে চিরদিনের মতাে এই সম্পর্ক শেষ করে দেয় পারুল। অমল বিদেশে চলে যায়, তার বিয়ে হয় মনার সঙ্গে। পারুলের স্বামী ব্যবসায়ী। সাংঘাতিক পরিশ্রমী ও সৎ মানুষ। পারুল সুখী, স্বামীর ব্যবসায়েরও সঙ্গী। সােহাগ অমলের মেয়ে। বাবা-মায়ের সঙ্গে গ্রামে। এসে এক অদ্ভুত পরিবর্তন সূচিত হয় তার জীবনে। পারুল তার কাছে গডেস’। এদিকে মনা ও অমলের সম্পর্ক ক্রমশ তিক্ত হয়ে উঠছে। কারণ এত বছর পরেও পারুলকে ভুলতে পারেনি অমল। গ্রামের আর এক আশ্চর্য মানুষ রসিক বাঙাল। তার দুটি বিয়ে। একজন থাকে গ্রামে, অন্যজন শহরে। বাঙালের দু’পক্ষের ছেলেমেয়েদের ভারী মিল। এদের জীবনযাপনের গল্প উপন্যাসে অন্য মাত্রা এনেছে—সহস্র সংকট ও দুঃখ-বেদনার মধ্যেও ভাল হওয়ার জন্য মানুষের কী অনন্ত পিপাসা! সমগ্র কাহিনীতে অনুপস্থিত থেকেও জীবন্ত চরিত্র গৌরহরি চট্টোপাধ্যায়। সােহাগের বন্ধু পান্নাও কাহিনীর অন্যতম গ্রন্থি। আর আছে একজন একটা বাস্তুসাপ। যার কোনও ভাষা নেই, ভূমিকা নেই। কিন্তু নিজের গতিপথে কুশীলবদের একই গণ্ডিতে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায় সে।। ‘চক্র’র কাহিনী জুড়ে আছে প্রেম, আত্মানুন্ধান, পুরনাে ধ্যান-ধারণা থেকে পুরনাে ধ্যান-ধারণা ছিন্ন করার প্রয়াস। আছে গ্রামীণ স্নিগ্ধ জীবনের অন্তরে নগরসভ্যতার ক্রমানুপ্রবেশের বিশ্বস্ত চিত্র। জীবন কত অমেয়—চক্র সেই কাহিনী বলেছে আশ্চর্য আন্তরিকতায়।
পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় ১৯৩৫ সালের ২রা নভেম্বর বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের টালমাটাল সময়ে পরিবারসমেত কলকাতা পাড়ি জমান। বাবার চাকরির সুবাদে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় শৈশব কেটেছে তার। কোচবিহার বোর্ডিং স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করেন তিনি। মাধ্যমিক পাস করেন কোচবিহার ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে। পরে কলকাতা কলেজ থেকে বিএ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। শীর্ষেন্দু তার পেশাজীবন শুরু করেন শিক্ষকতার মাধ্যমে। দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকায় সাংবাদিকতাও করেছেন কিছুদিন। বর্তমানে সাহিত্য পত্রিকা দেশ-এর সহকারী সম্পাদক পদে নিয়োজিত আছেন। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় ছোটবেলা থেকেই ভীষণ বইপড়ুয়া ছিলেন। হাতের কাছে যা পেতেন তা-ই পড়তেন। খুব ছোটবেলাতেই তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মানিক বন্দোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, তারাশংকর বন্দোপাধ্যায় এর মতো লেখকদের রচনাবলী পড়ে শেষ করেছেন। এই পড়ার অভ্যাসই তার লেখক সত্ত্বাকে জাগিয়ে তোলে। ১৯৫৯ সালে দেশ পত্রিকায় তার প্রথম গল্প ‘জলতরঙ্গ’ প্রকাশিত হয়। দীর্ঘ ৭ বছর পর দেশ পত্রিকাতেই প্রকাশিত হয় তার প্রথম উপন্যাস ‘ঘুণপোকা’। এরপর থেকেই নিয়মিত লিখতে থাকেন তিনি। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এর বই এর সংখ্যা দু’শতাধিক। তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস পার্থিব, দূরবীন, মানবজমিন, গয়নার বাক্স, যাও পাখি, পারাপার ইত্যাদি। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এর রহস্য সমগ্র রহস্যপ্রেমীদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। প্রায় ৪০ এর অধিক রহস্য গল্প প্রকাশিত হয়েছে ‘অদ্ভুতুরে সিরিজ’ নামকরণে। মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি, ভুতুড়ে ঘড়ি, হেতমগড়ের গুপ্তধন, নন্দীবাড়ির শাঁখ, ছায়াময় ইত্যাদি এই সিরিজের অন্তর্ভুক্ত। এছাড়াও তিনি বেশ কিছু ছোটগল্প রচনা করেছেন। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এর বই সমূহ দুই বাংলায় পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে সমানতালে। এছাড়াও শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এর বই সমগ্র অবলম্বনে বিভিন্ন সময় চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। তার উপন্যাস ‘যাও পাখি’ এবং ‘মানবজমিন’ নিয়ে বাংলাদেশেও ধারাবাহিক নাটক নির্মিত হয়েছে। তার সৃষ্ট চরিত্র শাবর দাশগুপ্ত এবং ধ্রুব পাঠক হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে। সাহিত্যে অবদানের জন্য অনেক পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। শিশু-কিশোরদের জন্য লেখা উপন্যাস ‘মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি’র জন্য ১৯৮৫ সালে ‘বিদ্যাসাগর পুরস্কার’ পান। ১৯৭৩ এবং ১৯৯০ সালে পেয়েছেন ‘আনন্দ পুরস্কার'। ১৯৮৮ সালে ‘মানবজমিন’ উপন্যাসের জন্য অর্জন করেন ‘সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার’। এছাড়াও, ২০১২ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রদত্ত সম্মান ‘বঙ্গবিভূষণ’ লাভ করেন তিনি।