'নরনারী কথা' বইয়ের ফ্লাপের লেখা রতনের জ্যাঠততাে দাদা পরাণ অনেকদিন হল বাউল হয়ে ঘর ছেড়েছে। বলা নেই। কওয়া নেই, হঠাৎ মারিয়া নামের এক মেমসাহেবকে সাধনসঙ্গিনী করে বাড়িতে এনে তুলেছে পরাণ। একটি প্রথাগত পরিবারে এই নারী এসে যেন উলটপালট করে দিল নরনারীর জীবনকাহিনী। রতনকে একলা পেয়ে আচমকা তার ঠোটে চুম্বন এঁকে দিল মারিয়া। রতনের কাছে এ এক গ্লানি। সে এখন সাম্যবাদী পার্টির রাজনীতিতে বিশ্বাস করে। পার্টির ছেলে সাম্যবাদ নামক এক স্বপ্নে রতন বিভাের। চুম্বনের গ্লানি সত্ত্বেও তার ভেতরে জেগে ওঠে এক নিষিদ্ধ আনন্দের সূচীমুখ। রতনের চারপাশে নানা ছাঁদের অক্ষরে লেখা হতে থাকে জীবনের গল্প। তার চিরদুঃখী মদ্যপ বাবা অভিরাম, যাত্রার নায়ক মনােজকুমারের সঙ্গে পালিয়ে যাওয়া তার মা সাবিত্রী, বড়দিদি রত্না, রত্নার বান্ধবী মধুরা ও মধুরার স্বামী বিমান এবং আরও অনেকে দীর্ঘদেহী রতনের যৌবনতরঙ্গের গল্পে যেন দুলতে থাকে। সকলের সঙ্গে তার সম্পর্ক রচিত হচ্ছে। আবার ব্যবসা, পারিবারিক বন্ধন ও পার্টি এই তিনটিকে নিয়ে রতন সােজা এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। গােপালগঞ্জের মহেন্দ্র বিশ্বাসের সঙ্গে দলের মিটিংয়ের শেষে দেখা হওয়ার পর থেকেই রতনের জীবনের গল্প বাঁক নিল অন্য খাতে। মহেন্দ্রর মেয়ে কেন এগিয়ে এসে রতনকে। বলল, আমি হৈমন্তী কী বলতে চেয়েছিল। বিপন্ন মেয়েটি? শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায়ের মরমী উপন্যাস নরনারী কথায় তারই উত্তর।
পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় ১৯৩৫ সালের ২রা নভেম্বর বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের টালমাটাল সময়ে পরিবারসমেত কলকাতা পাড়ি জমান। বাবার চাকরির সুবাদে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় শৈশব কেটেছে তার। কোচবিহার বোর্ডিং স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করেন তিনি। মাধ্যমিক পাস করেন কোচবিহার ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে। পরে কলকাতা কলেজ থেকে বিএ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। শীর্ষেন্দু তার পেশাজীবন শুরু করেন শিক্ষকতার মাধ্যমে। দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকায় সাংবাদিকতাও করেছেন কিছুদিন। বর্তমানে সাহিত্য পত্রিকা দেশ-এর সহকারী সম্পাদক পদে নিয়োজিত আছেন। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় ছোটবেলা থেকেই ভীষণ বইপড়ুয়া ছিলেন। হাতের কাছে যা পেতেন তা-ই পড়তেন। খুব ছোটবেলাতেই তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মানিক বন্দোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, তারাশংকর বন্দোপাধ্যায় এর মতো লেখকদের রচনাবলী পড়ে শেষ করেছেন। এই পড়ার অভ্যাসই তার লেখক সত্ত্বাকে জাগিয়ে তোলে। ১৯৫৯ সালে দেশ পত্রিকায় তার প্রথম গল্প ‘জলতরঙ্গ’ প্রকাশিত হয়। দীর্ঘ ৭ বছর পর দেশ পত্রিকাতেই প্রকাশিত হয় তার প্রথম উপন্যাস ‘ঘুণপোকা’। এরপর থেকেই নিয়মিত লিখতে থাকেন তিনি। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এর বই এর সংখ্যা দু’শতাধিক। তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস পার্থিব, দূরবীন, মানবজমিন, গয়নার বাক্স, যাও পাখি, পারাপার ইত্যাদি। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এর রহস্য সমগ্র রহস্যপ্রেমীদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। প্রায় ৪০ এর অধিক রহস্য গল্প প্রকাশিত হয়েছে ‘অদ্ভুতুরে সিরিজ’ নামকরণে। মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি, ভুতুড়ে ঘড়ি, হেতমগড়ের গুপ্তধন, নন্দীবাড়ির শাঁখ, ছায়াময় ইত্যাদি এই সিরিজের অন্তর্ভুক্ত। এছাড়াও তিনি বেশ কিছু ছোটগল্প রচনা করেছেন। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এর বই সমূহ দুই বাংলায় পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে সমানতালে। এছাড়াও শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এর বই সমগ্র অবলম্বনে বিভিন্ন সময় চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। তার উপন্যাস ‘যাও পাখি’ এবং ‘মানবজমিন’ নিয়ে বাংলাদেশেও ধারাবাহিক নাটক নির্মিত হয়েছে। তার সৃষ্ট চরিত্র শাবর দাশগুপ্ত এবং ধ্রুব পাঠক হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে। সাহিত্যে অবদানের জন্য অনেক পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। শিশু-কিশোরদের জন্য লেখা উপন্যাস ‘মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি’র জন্য ১৯৮৫ সালে ‘বিদ্যাসাগর পুরস্কার’ পান। ১৯৭৩ এবং ১৯৯০ সালে পেয়েছেন ‘আনন্দ পুরস্কার'। ১৯৮৮ সালে ‘মানবজমিন’ উপন্যাসের জন্য অর্জন করেন ‘সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার’। এছাড়াও, ২০১২ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রদত্ত সম্মান ‘বঙ্গবিভূষণ’ লাভ করেন তিনি।