"প্রজাপতি" বইটির ফ্ল্যাপ-এর লেখাঃ “উনিশ শাে পঁচাশি সালের চব্বিশে সেপ্টেম্বর ৩ তারিখটি বাংলা তথা ভারতীয় সাহিত্যেরই একটি স্মরণীয় দিন। ভারতের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে ওইদিনই নির্ধারিত হল সাহিত্যে শ্লীলতা-অশ্লীলতার স্পষ্টতর সীমারেখা। আঠারাে বছর ধরে অশ্লীলতার দায়ে নিষিদ্ধ গ্রন্থ, সমরেশ বসুর 'প্রজাপতি’, পেল সসম্মান পুনর্বাসন। মুক্ত ‘প্রজাপতি' ভারতীয় সাহিত্যের ক্ষেত্রে তৈরি করল এক নতুন, অনন্য নজির। সত্যিই ঐতিহাসিক এই ঘটনা, সেইসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের এই উদার, সংস্কারবর্জিত রায়ও অবিস্মরণীয়। দু-দুটি নিম্ন আদালতের রায়কে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে সুপ্রিম কোর্টের দুই মহামান্য বিচারপতি, শ্রীআর. এস পাঠক ও শ্রীঅমরেন্দ্রনাথ সেন, অশ্লীলতা সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণার নিরসন ঘটালেন। স্বচ্ছ, বাস্তবধর্মী দৃষ্টিভঙ্গির পরিচ্ছন্ন দৃষ্টান্ত রেখে তাঁরা তাঁদের রায়ে দেখালেন যে, কীভাবে পূর্ববর্তী আদালতের রায়ে ‘অমার্জিত’কে ‘অশ্লীল’-এর সঙ্গে এক করে ফেলা হয়েছে। তাঁদের সুচিন্তিত অভিমতে, ‘অমার্জিত (ভালগার) লেখা মাত্রেই যে ‘অশ্লীল’ (ওবসিন) হবে, একথা বলা যায় না। প্রজাপতির অংশবিশেষ হয়তাে কিছু পাঠকের কাছে অমার্জিত মনে হতে পারে, এর মধ্যে ব্যবহৃত অগতানুগতিক ও অশিষ্ট ভাষা (স্ল্যাং) একশ্রেণীর পাঠকরুচিকে আহত করতে পারে, অংশবিশেষের কিছু বর্ণনা কারও কারও কাছে মনে হতে পারে আপত্তিকর, কিন্তু তা সত্ত্বেও, সামগ্রিকভাবে, এ-গ্রন্থ'অশ্লীল নয়। পাঠকের নৈতিক চরিত্রকে কোনওভাবেই কলুষিত করবে না এবই বা এ-উপন্যাস পড়ে তাঁরা দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে উঠবেন না । প্রায় একই কথা বলেছিলেন কবি-সমালােচক বুদ্ধদেব বসুও। চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে চাঞ্চল্যকর ‘প্রজাপতি’-মামলায় অভিযুক্ত পক্ষের সাক্ষী হিসেবে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বুদ্ধদেব বসু এক প্রশ্নের উত্তরে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছিলেন, দুর্নীতিপরায়ণ করে তােলার বদলে এ-বই পাঠকের মনে সহানুভূতির উদ্রেক করবে। প্রজাপতি’র ভাষা সম্পর্কে বলতে গিয়ে বুদ্ধদেব বসুর দৃঢ় মন্তব্য, এর ভাষা অশ্লীল নয়। তাঁর কথায়, “এই বইয়ের নায়ক বা অ-নায়ক সমসাময়িক পশ্চিমবঙ্গের রকবাজ ছেলেদের টাইপ। এরা আমাদের সকলেরই পরিচিত। এই যুবকেরা সাধারণত যেসব ভাষায় কথা বলে, সেই ভাষাতেই এই উপন্যাস লেখা। এই বইতে এত বেশি স্ল্যাং’ ব্যবহারের এটাই যৌক্তিকতা। এই স্টাইল জীবন্ত এবং জীবনের অবিকল প্রতিচ্ছবি। এখানেই এ-উপন্যাসের সাফল্য।” বুদ্ধদেব বসু আরও বলেছিলেন, “হয়তাে এ-ভাষা সাহিত্যে বেশি ব্যবহৃত হয়নি। কিন্তু এ-ভাষা এখন ব্যাপকভাবে চালু। লেখক এই ভাষা ব্যবহার করে সাহিত্যের শ্রীবৃদ্ধিই ঘটিয়েছেন।” প্রায় একই কথা বলেছিলেন এ-মামলার অন্যতম সাক্ষী কবি-অধ্যাপক ডঃ নরেশ গুহও| তাঁরও দৃঢ় অভিমত, প্রজাপতি কোনওভাবেই পাঠকের নৈতিক চরিত্র কলুষিত করবে না। প্রজাপতি অশ্লীল নয়। না সামগ্রিকভাবে, না অংশত। কিন্তু মাননীয় চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট সম্পূর্ণ ভিন্নমত পােষণ করেছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল, ‘প্রজাপতি’ সাহিত্যগুণবর্জিত এক রচনা। এর কোনও শিক্ষাগত বা সামাজিক মূল্য নেই। সমাজের কল্যাণসাধনের অছিলায় বৃহত্তর ক্ষতিই করেছে প্রজাপতি। তাই তাঁর বিচারে, ভারতীয় দণ্ডবিধির ২৯২ ধারায়, লেখক দোষী সাব্যস্ত হন। ২৯২/১০৯ ধারায় দোষী সাব্যস্ত হন প্রকাশক। লেখক ও প্রকাশক-প্রত্যেকের ২০১ টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে দু-মাসের বিনাশ্রম কারাবাস, শাস্তি হিসেবে ধার্য হয়। সেইসঙ্গে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫২১ ধারায় শারদীয় ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘প্রজাপতি’ উপন্যাস থেকে মােট ৫৩ পৃষ্ঠা বর্জনের আদেশও দেন বিচারক। এই আদেশের বিরুদ্ধে অভিযােগকারী ও আসামী, উভয়পক্ষই দ্বারস্থ হন মহামান্য হাইকোর্টের। অভিযােগকারীর দাবি ছিল, কঠোরতর শাস্তিপ্রদান। নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে ছিল আসামীপক্ষের আপিল । হাইকোর্টেও পুরােপুরি বজায় রইল নিম্ন আদালতের রায়। সেইসঙ্গে নির্দেশ দেওয়া হল, শারদীয় ‘দেশ’ পত্রিকা ও গ্রন্থাকারে প্রকাশিত প্রজাপতি বাজেয়াপ্ত করে আপত্তিকর পৃষ্ঠাগুলি বর্জিত করা হােক। প্রকাশক ও লেখক মহামান্য হাইকোর্টের এই রায় মেনে নিতে পারেননি। এরপর তাঁরা গেলেন সুপ্রিম কোর্টে। সুপ্রিম কোর্টের চুড়ান্ত রায়ে ‘প্রজাপতি’ আজ সেই উপলক্ষেই মুক্ত প্রজাপতি’র এই নতুন সংস্করণ। মূল গ্রন্থের অবিকল পুনর্মুদ্রণ ছাড়াও এই সংস্করণে যুক্ত হয়েছে লেখক সমরেশ বসুর নতুন ভূমিকা, আদালতের সাক্ষ্য ও সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পূর্ণ বয়ানের বাংলা অনুবাদ। সাড়াজাগানাে, বিতর্কিত গ্রন্থকে ঘিরে যাবতীয় কৌতূহলের অবসান ঘটাবে এই নতুন সংস্করণ।
সমরেশ বসু (১৯২৪-১৯৮৮) প্রখ্যাত ভারতীয় বাঙালি লেখক, ঔপন্যাসিক। কালকূট ও ভ্রমর তার ছদ্মনাম। তার রচনায় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, শ্রমজীবী মানুষের জীবন এবং যৌনতাসহ বিভিন্ন অভিজ্ঞতার সুনিপুণ বর্ণনা ফুটে ওঠে। ১৯৮০ সালে তিনি সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। তার শৈশব কাটে বাংলাদেশের বিক্রমপুরে আর কৈশোর কাটে কলকাতার উপকণ্ঠ নৈহাটিতে। বিচিত্র সব অভিজ্ঞতায় তার জীবন ছিল পরিপূর্ণ। এক সময় মাথায় ফেরি করে ডিম বেচতেন। বিচিত্র বিষয় এবং আঙ্গিকে নিত্য ও আমৃত্যু ক্রিয়াশীল লেখকের নাম সমরেশ বসু। দেবেশ রায় তাঁর মৃত্যুতে লেখা রচনাটির শিরোনামই দিয়েছিলেন, 'জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি লেখক এবং পেশাদার লেখক'। ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত তিনি ইছাপুরের গান ফ্যাক্টরিতে কাজ করেন। ট্রেড ইউনিয়ন ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন তিনি। এ কারণে তাকে ১৯৪৯-৫০ সালে জেলও খাটতে হয়, জেলখানায় তিনি তার প্রথম উপন্যাস ‘উত্তরঙ্গ’ রচনা করেন। জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি লেখালেখিকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। কালকূট মানে তীব্র বিষ। এটি তাঁর ছদ্মনাম। 'অমৃত কুম্ভের সন্ধানে', 'কোথায় পাব তারে' সহ অনেক উপন্যাস তিনি এ নামে লিখেছেন। বহমান সমাজ থেকে বাইরে গিয়ে একান্তে বেড়াতে ঘুরে বেরিয়েছেন আর সে অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন ভ্রমণধরমী উপন্যাস । হিংসা, মারামারি আর লোলুপতার বেড়াজালে আবদ্ধ থেকে যে জীবন দুর্বিসহ হয়ে উঠেছিল, সেখান থেকে বেড়িয়ে এসে অমৃতের সন্ধান করেছেন । তাই কালকূট নাম ধারণ করে হৃদয়ের তীব্র বিষকে সরিয়ে রেখে অমৃত মন্থন করেছেন উপন্যাসের মধ্য দিয়ে৷ “অমৃত বিষের পাত্রে”, “মন মেরামতের আশায়”, 'হারায়ে সেই মানুষে', 'তুষার শৃঙ্গের পদতলে' ইত্যাদি এই ধারার উপন্যাস। ছদ্ম নামে লেখা শাম্ব উপন্যাসের জন্য তিনি ১৯৮০ সালের আকাদেমি পুরস্কার পেয়েছিলেন। লেখক হিসেবে সমরেশ আমৃত্যু যে লড়াই করেছেন তার কোনো তুলনা নেই। তাঁর নিজের জীবনই আরেক মহাকাব্যিক উপন্যাস। 'চিরসখা' নামের প্রায় ৫ লাখ শব্দের বিশাল উপন্যাসে সেই লড়াইকে স্মরণীয় করে রেখেছেন তারই পুত্র নবকুমার বসু। ছোটদের জন্যে সৃষ্ট গোয়েন্দা গোগোল অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়। গোগোলকে নিয়ে বহু ছোটগল্প ও উপন্যাস লিখেছেন যা শিশুসাহিত্য হিসেবে সমান জনপ্রিয়তা পেয়েছে। গোগোলের দুটি কাহিনী চলচ্চিত্রায়িতও হয়।