এক নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখেছিল রুহিতন এ করছি। উত্তরে বাংলার তরাই অঞ্চলের নকশালবাড়ির লাগোয়া রাঙালী গ্রামের ভূমিহীন কৃষিশ্রমিক রুহিতন;- যে স্বপ্নের সাফল্যে অন্ধ দৃষ্টি ফিরে পায়, বোবায় কথা কয়, বন্ধ্যা নারীর সন্তান হয়, ভূমিহীন ভূমি পায়, জনমজুরে রাজ্য চালায়। সেই স্বপ্নের জগৎ গড়ে তুলতে চেয়েছিল রুহিতন তার জীবনের সব কিছু পণ রেখে। শুরু হয়েছিল মুক্ত অঞ্চল গড়ার, শ্রেণী-শত্রুকে খতম করার, গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার লড়াই। কিন্তু, তারপর, কোথা দিয়ে যে কি হয়! কোথায় ঘনায় মেঘ, কোথায় বরষায়; আর, জীবনের রঙিন কাপড়খানি যায় সপসপিয়ে ভিজে! জীবন বোধ হয় এইরকমই। নইলে মহাকালের রথটিকে আগিয়ে নিয়ে যাওয়ার স্পর্ধায় যার স্ফীত নাসারন্ধ্রে দেখা দিয়েছিল অগ্নিস্ফুলিঙ্গ, উদ্ধত গ্রীবার ফুলে-ওঠা কেশরগুলি হাওয়ায় নেচে নেচে উঠেছিল, আর গতির আবেগে চঞ্চল হয়ে উঠেছিল বলদৃপ্ত চরণপেশীগুলি, তাকেই দলিত পিষ্ট করে চলে যায় কেন নিষ্ঠুর মহাকালের চিরচলিষ্ণু নির্মম রথচক্র? সমরেশ বসুর উপন্যাস ‘মহাকালের রথের ঘোড়া’ নকশালবাড়ি আন্দোলনের পটভূমিতে লেখা এক আপাতব্যৰ্থ মহান সংগ্রামীর বিফলস্বপ্নের হৃদয়দ্রাবী বাকরোধী কাহিনী— যা বাস্তবের আর কল্পনার তাৎক্ষণিক সত্যের সংমিশ্রণে উন্নীত হয়েছে শিল্পের এক চিরসত্যে।
সমরেশ বসু (১৯২৪-১৯৮৮) প্রখ্যাত ভারতীয় বাঙালি লেখক, ঔপন্যাসিক। কালকূট ও ভ্রমর তার ছদ্মনাম। তার রচনায় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, শ্রমজীবী মানুষের জীবন এবং যৌনতাসহ বিভিন্ন অভিজ্ঞতার সুনিপুণ বর্ণনা ফুটে ওঠে। ১৯৮০ সালে তিনি সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। তার শৈশব কাটে বাংলাদেশের বিক্রমপুরে আর কৈশোর কাটে কলকাতার উপকণ্ঠ নৈহাটিতে। বিচিত্র সব অভিজ্ঞতায় তার জীবন ছিল পরিপূর্ণ। এক সময় মাথায় ফেরি করে ডিম বেচতেন। বিচিত্র বিষয় এবং আঙ্গিকে নিত্য ও আমৃত্যু ক্রিয়াশীল লেখকের নাম সমরেশ বসু। দেবেশ রায় তাঁর মৃত্যুতে লেখা রচনাটির শিরোনামই দিয়েছিলেন, 'জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি লেখক এবং পেশাদার লেখক'। ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত তিনি ইছাপুরের গান ফ্যাক্টরিতে কাজ করেন। ট্রেড ইউনিয়ন ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন তিনি। এ কারণে তাকে ১৯৪৯-৫০ সালে জেলও খাটতে হয়, জেলখানায় তিনি তার প্রথম উপন্যাস ‘উত্তরঙ্গ’ রচনা করেন। জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি লেখালেখিকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। কালকূট মানে তীব্র বিষ। এটি তাঁর ছদ্মনাম। 'অমৃত কুম্ভের সন্ধানে', 'কোথায় পাব তারে' সহ অনেক উপন্যাস তিনি এ নামে লিখেছেন। বহমান সমাজ থেকে বাইরে গিয়ে একান্তে বেড়াতে ঘুরে বেরিয়েছেন আর সে অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন ভ্রমণধরমী উপন্যাস । হিংসা, মারামারি আর লোলুপতার বেড়াজালে আবদ্ধ থেকে যে জীবন দুর্বিসহ হয়ে উঠেছিল, সেখান থেকে বেড়িয়ে এসে অমৃতের সন্ধান করেছেন । তাই কালকূট নাম ধারণ করে হৃদয়ের তীব্র বিষকে সরিয়ে রেখে অমৃত মন্থন করেছেন উপন্যাসের মধ্য দিয়ে৷ “অমৃত বিষের পাত্রে”, “মন মেরামতের আশায়”, 'হারায়ে সেই মানুষে', 'তুষার শৃঙ্গের পদতলে' ইত্যাদি এই ধারার উপন্যাস। ছদ্ম নামে লেখা শাম্ব উপন্যাসের জন্য তিনি ১৯৮০ সালের আকাদেমি পুরস্কার পেয়েছিলেন। লেখক হিসেবে সমরেশ আমৃত্যু যে লড়াই করেছেন তার কোনো তুলনা নেই। তাঁর নিজের জীবনই আরেক মহাকাব্যিক উপন্যাস। 'চিরসখা' নামের প্রায় ৫ লাখ শব্দের বিশাল উপন্যাসে সেই লড়াইকে স্মরণীয় করে রেখেছেন তারই পুত্র নবকুমার বসু। ছোটদের জন্যে সৃষ্ট গোয়েন্দা গোগোল অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়। গোগোলকে নিয়ে বহু ছোটগল্প ও উপন্যাস লিখেছেন যা শিশুসাহিত্য হিসেবে সমান জনপ্রিয়তা পেয়েছে। গোগোলের দুটি কাহিনী চলচ্চিত্রায়িতও হয়।