"যুগ যুগ জীয়ে” বইয়ের ফ্ল্যাপের লেখা: এ কাহিনীর শুরু এক। বিপন্ন সময়ে, যখন বাতাসে কেবল বারুদের গন্ধ। সারা দেশ গুলিগােলার শব্দে র রন্ বুমবুম। আকাশে ওড়ে বিমানের ঝাক। দিকে দিকে গর্জায় কামান। ফ্যাসিজমের উদ্যত থাবা দেশ থেকে দেশান্তরে। হিটলার, রাশিয়া, জাপানী বােমা, গান্ধী, সুভাষ বসু, ফজলুল হক, মিত্রপক্ষ, আত্মপক্ষ এরকম অনেক শব্দ তখন প্রতি মুহুর্তের জাগ্রত কৌতুহল। একাহিনীর শুরু সেই অদ্ভুত সময়ে, মেদিনীপুরে। চলছে গােপন বিপ্লবের প্রস্তুতি, আপসহীন যুদ্ধ ভারত ছাড়াে’র জন্য তৈরি হচ্ছে বাহিনী, কলকাতা ও শিল্পাঞ্চল জুড়ে সামরিক ছাউনি, গােরা সৈন্যের মার্চ, সাইরেন, হু-হু করে বেড়ে যাচ্ছে জিনিসপত্রের দাম, হাত থেকে হাতে ঘুরছে। নিষিদ্ধ কাস্তে-হাতুড়ি ছাপ-দেওয়া বই, সংগঠিত হচ্ছে কৃষক ফ্রন্ট আর শ্রমিক ফ্রন্ট, সে এক অদ্ভুত সময়। একাহিনীর শুরু সেই দুরন্ত সময়ে, শিল্পাঞ্চল আর কলকাতার ব্যাপ্ত পটভূমিকাকে আশ্রয় করে। এক দিকে বিপন্ন, অদ্ভুত, দুরন্ত সময়, অন্য দিকে কিছু মানুষের জীবনের স্রোত যা এই সময়ের সঙ্গে অচ্ছেদ্য সূত্রে গাঁথা। অনেক ঘটনার পরম্পরায়, অনেক জটিল সংঘাতমুখর পরিস্থিতির বিদ্যুন্নিভ আলােয় ক্রমশ সেই মানুষগুলির চেহারা স্পষ্ট, ক্রমশ ধরা পড়েছে এক সময়ের অবয়ব। এবং শুধু একটি বিশেষ সময় ও সেই সময়ে বন্দি মানুষগুলির চেহারাই শুধু স্পষ্ট হয়নি, সমরেশ বসুর তীব্র, সন্ধানী কলমের আঁচড়ে ফুটে উঠেছে। এক মহত্তর সত্যও, যা জানিয়ে দেয় বিদ্রোহ আর বিপ্লব অন্তহীন, অমর মানুষ চিরদিনের বিদ্রোহী।
সমরেশ বসু (১৯২৪-১৯৮৮) প্রখ্যাত ভারতীয় বাঙালি লেখক, ঔপন্যাসিক। কালকূট ও ভ্রমর তার ছদ্মনাম। তার রচনায় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, শ্রমজীবী মানুষের জীবন এবং যৌনতাসহ বিভিন্ন অভিজ্ঞতার সুনিপুণ বর্ণনা ফুটে ওঠে। ১৯৮০ সালে তিনি সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। তার শৈশব কাটে বাংলাদেশের বিক্রমপুরে আর কৈশোর কাটে কলকাতার উপকণ্ঠ নৈহাটিতে। বিচিত্র সব অভিজ্ঞতায় তার জীবন ছিল পরিপূর্ণ। এক সময় মাথায় ফেরি করে ডিম বেচতেন। বিচিত্র বিষয় এবং আঙ্গিকে নিত্য ও আমৃত্যু ক্রিয়াশীল লেখকের নাম সমরেশ বসু। দেবেশ রায় তাঁর মৃত্যুতে লেখা রচনাটির শিরোনামই দিয়েছিলেন, 'জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি লেখক এবং পেশাদার লেখক'। ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত তিনি ইছাপুরের গান ফ্যাক্টরিতে কাজ করেন। ট্রেড ইউনিয়ন ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন তিনি। এ কারণে তাকে ১৯৪৯-৫০ সালে জেলও খাটতে হয়, জেলখানায় তিনি তার প্রথম উপন্যাস ‘উত্তরঙ্গ’ রচনা করেন। জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি লেখালেখিকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। কালকূট মানে তীব্র বিষ। এটি তাঁর ছদ্মনাম। 'অমৃত কুম্ভের সন্ধানে', 'কোথায় পাব তারে' সহ অনেক উপন্যাস তিনি এ নামে লিখেছেন। বহমান সমাজ থেকে বাইরে গিয়ে একান্তে বেড়াতে ঘুরে বেরিয়েছেন আর সে অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন ভ্রমণধরমী উপন্যাস । হিংসা, মারামারি আর লোলুপতার বেড়াজালে আবদ্ধ থেকে যে জীবন দুর্বিসহ হয়ে উঠেছিল, সেখান থেকে বেড়িয়ে এসে অমৃতের সন্ধান করেছেন । তাই কালকূট নাম ধারণ করে হৃদয়ের তীব্র বিষকে সরিয়ে রেখে অমৃত মন্থন করেছেন উপন্যাসের মধ্য দিয়ে৷ “অমৃত বিষের পাত্রে”, “মন মেরামতের আশায়”, 'হারায়ে সেই মানুষে', 'তুষার শৃঙ্গের পদতলে' ইত্যাদি এই ধারার উপন্যাস। ছদ্ম নামে লেখা শাম্ব উপন্যাসের জন্য তিনি ১৯৮০ সালের আকাদেমি পুরস্কার পেয়েছিলেন। লেখক হিসেবে সমরেশ আমৃত্যু যে লড়াই করেছেন তার কোনো তুলনা নেই। তাঁর নিজের জীবনই আরেক মহাকাব্যিক উপন্যাস। 'চিরসখা' নামের প্রায় ৫ লাখ শব্দের বিশাল উপন্যাসে সেই লড়াইকে স্মরণীয় করে রেখেছেন তারই পুত্র নবকুমার বসু। ছোটদের জন্যে সৃষ্ট গোয়েন্দা গোগোল অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়। গোগোলকে নিয়ে বহু ছোটগল্প ও উপন্যাস লিখেছেন যা শিশুসাহিত্য হিসেবে সমান জনপ্রিয়তা পেয়েছে। গোগোলের দুটি কাহিনী চলচ্চিত্রায়িতও হয়।