কে যেন বলেছিলেন, সমরেশ বসু বাংলা সাহিত্যের রাজপুত্র । ছিদ্রান্বেষীরা এই মন্তব্যকে অতিশয়োক্তি বলে বাতিল করে দিতে পারেন । কিন্তু একথা কি অস্বীকার করা যাবে, সাহিত্যে তিনি ছিলেন বনস্পতির মতো এক বিশাল প্রতিভা ! প্রতিকূলকে অনুকূল করে তোলার সংগ্রামী মনোভাব নিয়ে অতি সাধারণ স্তর থেকে তিনি উঠে এসেছিলেন খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠার শিখরে। তাঁর সাহিত্য যেমন বিষয়-বৈচিত্র্যে বিভিন্ন সময়ে বাঁক নিয়েছে প্রবহমান নদীর মতো, তাঁর জীবনও সেইরকম বিচিত্রপদে এগিয়ে গিয়েছিল, বেঁচে থাকার রঙ ছড়াতে ছড়াতে। জীবন নিয়ে তীব্র কোনও নৈতিকতা বা আদর্শের আদিখ্যেতা ছিল না তাঁর। জীবনাচরণে, বেঁচে থাকার ধরনে তিনি ছিলেন পুরোপুরি স্বভাবস্বতন্ত্র। জীবন ও সাহিত্য এক হয়ে গিয়েছিল বলেই সমরেশের সৃষ্টিতে কোনও ফাঁকি ছিল না । নিজেই এক জায়গায় লিখেছেন : ‘সাহিত্যের যা কিছু দায়, সে তো জীবনেরই কাছে। সাহিত্যের থেকে জীবন বড়, এ সত্যের জন্য, সাহিত্যিককে গভীর অনুশীলন করতে হয় না, তা সততই অতি জীবন্ত। ' রক্তমাংসের নারী পুরুষ, যারা সব অর্থেই মৃত্তিকাসংলগ্ন, তারাই এসেছে তাঁর সাহিত্যের টানাপোড়েনে । কাউকে তিনি বাদ দেননি ফেরাননি। মানুষের তল খুঁজতে শরীরী সম্পর্ককে বিশ্বাস করেছেন তিনি। ফলে তাঁকে প্রতিমুহূর্তে ভুল বোঝার সম্ভাবনা । সমরেশ বিশ্বাস করতেন, জীবনকে সাপটে ধরতে হলে কেবল জীবনশিল্পী হলেই চলে না, হতে হয় জীবনশিকারি। সমরেশ যেন ছিলেন তাই । জীবনশিল্পী, জীবনশিকারি সমরেশের সাহিত্যজীবনের প্রথম পর্ব বা ‘উদয়ন পর্ব শুরু হয়েছিল ‘নয়নপুরের মাটি থেকে। যদিও তাঁর প্রথম ছাপা উপন্যাস ‘উত্তরঙ্গ'। রচনাকালের দিক থেকে দ্বিতীয় হলেও। শুরু থেকে শেষদিন পর্যন্ত সমরেশ উপন্যাসের দিকবদল করেছেন। কখনই এক জায়গায় থেমে থাকেননি। এই প্রথম খণ্ডে গৃহীত হয়েছে ১৯৫১ থেকে ১৯৫৩ পর্যন্ত প্রকাশিত তাঁর প্রথম পর্বের চারটি উপন্যাস : নয়নপুরের মাটি, উত্তরঙ্গ, বি টি রোডের ধারে ও শ্রীমতী কাফে । আর ওই পর্বে (১৯৫৩-৫৬) মুদ্রিত তিনটি গল্পগ্রন্থ : মরশুমের একদিন, অকাল বৃষ্টি এবং ষষ্ঠ ঋতু । ঔপন্যাসিক সমরেশ ও ছোটগল্পকার সমরেশ—এই দুই সত্তার মানস- অভিজ্ঞানের পরিচয়টি অনবদ্য বিশ্লেষণে পরিস্ফুট করেছেন সমরেশের আবাল্যবন্ধু অধ্যাপক সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়, এই খণ্ডের ভূমিকায় ।
সমরেশ বসু (১৯২৪-১৯৮৮) প্রখ্যাত ভারতীয় বাঙালি লেখক, ঔপন্যাসিক। কালকূট ও ভ্রমর তার ছদ্মনাম। তার রচনায় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, শ্রমজীবী মানুষের জীবন এবং যৌনতাসহ বিভিন্ন অভিজ্ঞতার সুনিপুণ বর্ণনা ফুটে ওঠে। ১৯৮০ সালে তিনি সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। তার শৈশব কাটে বাংলাদেশের বিক্রমপুরে আর কৈশোর কাটে কলকাতার উপকণ্ঠ নৈহাটিতে। বিচিত্র সব অভিজ্ঞতায় তার জীবন ছিল পরিপূর্ণ। এক সময় মাথায় ফেরি করে ডিম বেচতেন। বিচিত্র বিষয় এবং আঙ্গিকে নিত্য ও আমৃত্যু ক্রিয়াশীল লেখকের নাম সমরেশ বসু। দেবেশ রায় তাঁর মৃত্যুতে লেখা রচনাটির শিরোনামই দিয়েছিলেন, 'জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি লেখক এবং পেশাদার লেখক'। ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত তিনি ইছাপুরের গান ফ্যাক্টরিতে কাজ করেন। ট্রেড ইউনিয়ন ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন তিনি। এ কারণে তাকে ১৯৪৯-৫০ সালে জেলও খাটতে হয়, জেলখানায় তিনি তার প্রথম উপন্যাস ‘উত্তরঙ্গ’ রচনা করেন। জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি লেখালেখিকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। কালকূট মানে তীব্র বিষ। এটি তাঁর ছদ্মনাম। 'অমৃত কুম্ভের সন্ধানে', 'কোথায় পাব তারে' সহ অনেক উপন্যাস তিনি এ নামে লিখেছেন। বহমান সমাজ থেকে বাইরে গিয়ে একান্তে বেড়াতে ঘুরে বেরিয়েছেন আর সে অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন ভ্রমণধরমী উপন্যাস । হিংসা, মারামারি আর লোলুপতার বেড়াজালে আবদ্ধ থেকে যে জীবন দুর্বিসহ হয়ে উঠেছিল, সেখান থেকে বেড়িয়ে এসে অমৃতের সন্ধান করেছেন । তাই কালকূট নাম ধারণ করে হৃদয়ের তীব্র বিষকে সরিয়ে রেখে অমৃত মন্থন করেছেন উপন্যাসের মধ্য দিয়ে৷ “অমৃত বিষের পাত্রে”, “মন মেরামতের আশায়”, 'হারায়ে সেই মানুষে', 'তুষার শৃঙ্গের পদতলে' ইত্যাদি এই ধারার উপন্যাস। ছদ্ম নামে লেখা শাম্ব উপন্যাসের জন্য তিনি ১৯৮০ সালের আকাদেমি পুরস্কার পেয়েছিলেন। লেখক হিসেবে সমরেশ আমৃত্যু যে লড়াই করেছেন তার কোনো তুলনা নেই। তাঁর নিজের জীবনই আরেক মহাকাব্যিক উপন্যাস। 'চিরসখা' নামের প্রায় ৫ লাখ শব্দের বিশাল উপন্যাসে সেই লড়াইকে স্মরণীয় করে রেখেছেন তারই পুত্র নবকুমার বসু। ছোটদের জন্যে সৃষ্ট গোয়েন্দা গোগোল অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়। গোগোলকে নিয়ে বহু ছোটগল্প ও উপন্যাস লিখেছেন যা শিশুসাহিত্য হিসেবে সমান জনপ্রিয়তা পেয়েছে। গোগোলের দুটি কাহিনী চলচ্চিত্রায়িতও হয়।