বাঙালির জীবনের তিমির, বাধার বিন্ধ্যাচল উড়িয়ে যে বিদ্রোহ এসেছিল তাঁর নাম- কাজী নজরুল ইসলাম। ঔপনিবেশিক শাসনে রুদ্ধ-নিমজ্জিত প্রতিটি মুক্তিকামীর জাতীয়তা বোধ, স্বাধীনতার আশায় তিনি ছিলেন উচ্চকিত। শুধু নিজেরই নয়, সেই সঙ্গে সমাজের- মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তিকেও বোঝার চেষ্টা যে করেছিলেন সাম্যবাদী এই বিদ্রোহী। যে সক্ষমতা নজরুল অর্জন করেছিলেন কেবল যুক্তি দিয়েই নয়, আবেগ দিয়েও। আবার এও সত্যি যে, নজরুল শুধুই আবেগপ্রবণ ছিলেন না; আবেগের উদ্দাম শক্তিকে তিনি কাজেও লাগিয়েছিলেন। নজরুলের যুক্তি, তাঁর রাজনীতি প্রবলে প্রতিভাত হয়ে ওঠে প্রবন্ধে। কলমকে হাতিয়ার করে যখন তিনি সমাজ বদলের স্বপ্ন দেখেন, স্বপ্নের কথা বন্ধু-পাঠককে বলেন সেসময়। নজরুলের স্বপ্নের শক্তি এমনই যে তাঁর প্রথম প্রবন্ধ সংকলনটিই বাজেয়াপ্ত হয়, যুগবাণী। ঔপনিবেশিক শোষকরা পরাধীন ভারতবর্ষের ‘জাতীয় বিপ্লবের সার্থক সাহিত্যিক প্রতিভূ’ নজরুলের কবিতা-গানকে শুধু নয়, তাঁর প্রবন্ধকেও শত্রু ঘোষণা করে। মানুষের ভাবনার বহুত্ববাদী উজ্জ্বল কাঠামোর দেদীপ্যমান স্মারক নজরুলের প্রবন্ধ উদ্ভাসিত শোষণের বিরুদ্ধতায়, চিন্তার প্রকরণে, শিক্ষায়। আর স্বতন্ত্র এক পৌরুষদীপ্ত স্বরে। যা নজরুলের যাবতীয় বিশ্বাস, উচ্ছ্বাস, উদ্দীপনা নিয়েও একই সঙ্গে শৈল্পিকভাবে স্বকীয়।
১৮৯৯ সালের ২৪ মে (১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ) পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, গীতিনাট্যকার, অভিনয়শিল্পী, সুরকার ও প্রবন্ধকার। নজরুলের বাল্যকাল কেটেছে দুঃখ-দুর্দশায়। তাই তাঁর ডাকনাম ছিলো দুখু মিয়া। তাঁর বৈচিত্র্যময় শিক্ষাজীবন শুরু হয় গ্রামের মক্তবে। পিতৃহীন হওয়ার পর তিনি পড়ালেখা ছেড়ে যোগ দেন লেটোর দলে, যেখান থেকে তিনি কবিতা ও গান রচনার কৌশল রপ্ত করেন। পরবর্তীতে এক বছর ময়মনসিংহের দরিরামপুর হাই স্কুলে পড়ে পুনরায় চুরুলিয়ায় রানীগঞ্জের শিয়ারসোল রাজ স্কুলে ভর্তি হন, এবং সেখানে তিন বছর অধ্যয়ন করেন। প্রবেশিকা পরীক্ষার আগেই তাকে পড়ালেখা ছাড়তে হয় যুদ্ধে যোগদানের জন্য। যুদ্ধের দিনগুলোতে নানা জায়গায় অবস্থান করলেও তার করাচির সৈনিকজীবনই উল্লেখযোগ্য, কেননা সেসময়েই তার প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায় ‘বাউণ্ডেলের আত্মকাহিনী’ নামক গল্প প্রকাশের মাধ্যমে। কাজী নজরুল ইসলাম এর বই সমূহ’র বিষয়বস্তু বিবিধ। তবে কাজী নজরুল ইসলাম এর বই-এ সমকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক যন্ত্রণা এবং সাম্যবাদের ধারণা প্রকটভাবে স্থান করে নিয়েছে। রাবীন্দ্রিক যুগে তার সাহিত্য প্রতিভা উন্মোচিত হলেও তার সৃষ্টি সম্পূর্ণ ভিন্ন। কাজী নজরুল ইসলাম এর বই সমগ্র এর মাঝে উল্লেখযোগ্য হলো ‘রিক্তের বেদন’, ‘দোলনচাঁপা’, ‘বিষের বাঁশি’, ‘সাম্যবাদী’, ‘সর্বহারা’, ‘প্রলয়শিখা’ ইত্যাদি। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী নজরুল ‘সাপ্তাহিক লাঙল’, দ্বিসাপ্তাহিক পত্রিকা ‘ধূমকেতু’র সম্পাদক ছিলেন। বাংলাদেশের জাতীয় কবি এবং বাংলা সাহিত্যের বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ২৯ আগস্ট ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।