বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সুদ এমন একটি অভিশাপ, যে সমগ্র বিশ্বকে তার বেষ্টনীর মধ্যে নিয়ে এসেছে। কুরআন ও সুন্নায় তার হারাম হওয়ার বিষয়টি যত বিস্তারিতভাবে আলোচিত হয়েছে, তার উপর যে কঠোর সতর্কবাণী ঘোষিত হয়েছে, সম্ভবত অন্য কোনো গুনাহের জন্য তা হয় নি। এ বিষয়ে কুরআন ও সুন্নাহর বিধান আমার মুহতারাম আব্বাজান রাহ. তাঁর 'মাসআলায়ে সুদ' গ্রন্থে বিস্তারিত ব্যাখ্যাসহ আলোচনা করেছেন। তাঁরই নির্দেশে আমি অধম আঠার বছর বয়সে ওই গ্রন্থের দ্বিতীয় অংশ লিখেছিলাম 'তিজারতি সুদ' শিরোনামে, যার মধ্যে ওই লোকদের জবাব দিয়েছিলাম যারা বর্তমান ব্যাংকের সুদকে জায়েয বলার চেষ্টা করে। এর পরেও এ বিষয়ের উপর অধমের কয়েকটি গ্রন্থ ও প্রবন্ধ রচনার সুযোগ হয়েছে, যার সর্বশেষ গ্রন্থটি আমি সুপ্রিম কোর্টের শরীয়ত অ্যাপিলেট ব্যাঞ্চের বিচারক হিসেবে একটি ফয়সালার আকারে লিখেছিলাম এবং 'সুদ পর তারিখী ফয়সালা' শিরোনামে তা প্রকাশিত হয়েছে।
আমাদের আকাবিরদের মধ্যে হযরত মাওলানা মুফতি শফী সাহেব হযরত মাওলানা যফর আহমাদ উসমানী সাহেব হযরত মাওলানা ইউসুফ বিন্নুরী সাহেব হযরত মাওলানা মুফতি রশীদ আহমাদ সাহেব হযরত মাওলানা মুফতি আব্দুশ শাকুর তিরমিযী সাহেব হযরত মাওলানা শামসুল হক আফগানী সাহেব হযরত মাওলানা মুফতি অলী হাসান সাহেব (রাহিমাহুমুল্লাহু তাআলা) প্রভৃতি হযরাতদের ব্যাপারে অধমের স্মরণ আছে, তাঁরা সকলেই বর্তমান ব্যাংকব্যবস্থাকে সুদ থেকে পবিত্র করে এমন বিকল্প ব্যবস্থা চালু করার চিন্তা করছিলেন যার মাধ্যমে এ হারাম কারবার থেকে মুক্তি লাভ করা যায়। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ এ বিষয়বস্তুর উপর কলমও ধরেছেন, কেউ তার জন্য কার্যকর চেষ্টাও চালিয়েছেন। হযরত ওয়ালিদ সাহেব রাহ.-এর ব্যাপারে আমার স্মরণ আছে, তিনি আমার শৈশবকালে চৌধুরী মুহাম্মাদ আলী সাহেব মরহুমের সাথে- যিনি সে সময় অর্থমন্ত্রী ছিলেন এবং পরে প্রধানমন্ত্রীও হয়েছিলেন- এ বিষয় নিয়ে দীর্ঘ বৈঠক করেছেন এবং সুদমুক্ত ব্যাংকব্যবস্থার একটি নমুনাও তৈরি করেছিলেন। তারপর রাষ্ট্রপতি মুহাম্মাদ আইয়ুব খান সাহেব মরহুমের আমলে শেখ আহমাদ আরশাদ সাহেব করাচিতে শরয়ী মূলনীতির উপর একটি কো-অপারেটিভ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করার ইচ্ছা পোষণ করলে তিনি হযরত মুফতি শফী সাহেব রাহ. এবং হযরত বিনুরী সাহেব রাহ.-এর কাছে ঘনঘন আসা যাওয়া করতেন (এ ব্যাংকের ব্যাপারে হযরত বিন্নুরী সাহেব রাহ.-এর প্রতিক্রিয়া আলোচিত গ্রন্থে আসছে)।
প্রখ্যাত ইসলামি ব্যক্তিত্ব শাইখুল ইসলাম মুফতী মুহাম্মদ তকী উসমানী শুধু ইসলামের নানা বিষয় নিয়ে বই রচনা করেননি, তিনি একাধারে ইসলামি ফিকহ, হাদীস, তাসাউফ ও ইসলামি অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ। আর তা-ই নয়, তিনি একজন বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শরীয়াহ আদালতে, এমনকি পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের শরীয়াহ আপিল বেঞ্চেরও বিচারক পদে আসীন ছিলেন। মুফতী মুহাম্মদ তকী উসমানী ভারতের উত্তর প্রদেশের দেওবন্দে ১৯৪৩ সালের ৫ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগ হয়ে ভারত ও পাকিস্তান দুটি আলাদা রাষ্ট্রে পরিণত হলে তার পরিবার পাকিস্তানে চলে আসে এবং এখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। শিক্ষাজীবনে তিনি বিভিন্ন জায়গা থেকে ইসলামি নানা বিষয়সহ অন্যান্য বিষয়েও শিক্ষা নিয়েছেন। তিনি করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন, যেখান থেকে অর্থনীতি, আইনশাস্ত্র ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ডিগ্রি অর্জন করেন। আর পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লাভ করেছেন আরবি ভাষা ও সাহিত্যে এম.এ. ডিগ্রি। দারুল উলুম করাচি থেকে পিএইচডি সমমানের ডিগ্রি অর্জন করেছেন ইসলামি ফিকহ ও ফতোয়ার উপর। সর্বোচ্চ স্তরের দাওয়া হাদিসের শিক্ষাও তিনি একই প্রতিষ্ঠান থেকে গ্রহণ করেন। বিচারকের দায়িত্ব পালন ছাড়াও বিভিন্ন ইসলামি বিষয়, যেমন- ফিকহ, ইসলামি অর্থনীতি ইত্যাদি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আন্তর্জাতিক ফিকহ একাডেমির স্থায়ী সদস্যপদ রয়েছে তাঁর। পাকিস্তানে 'মিজান ব্যাংক' নামক ইসলামি ব্যাংকিং সিস্টেম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পাকিস্তানে ইসলামি অর্থনীতির প্রসারে তিনি বিশেষ অবদান রেখেছেন। তিনি রচনা করেছেন অসংখ্য বইও। তকী উসমানীর বই এর সংখ্যা ৬০ এর অধিক। শাইখুল ইসলাম মুফতী মুহাম্মদ তকী উসমানী এর বই সমূহ রচিত হয়েছে ইংরেজি, আরবি ও উর্দু ভাষায়। শাইখুল ইসলাম মুফতী মুহাম্মদ তকী উসমানী এর বই সমগ্র এর মধ্যে 'Easy Good Deeds', 'Spiritual Discourses', 'What is Christianity?', 'Radiant Prayers' ইত্যাদি ইংরেজি বই, ও 'তাবসেরে', 'দুনিয়া মেরে আগে', 'আসান নেকিয়া' ইত্যাদি উর্দু বই উল্লেখযোগ্য। এসকল বই ইসলাম প্রসারে, এবং বিভিন্ন ইসলামি ব্যাখ্যা প্রদান ও আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।