“নিম্নবর্গের ইতিহাস" বইটির ফ্ল্যাপ এর লেখাঃ ভারতে নিম্নবর্গের ইতিহাস চিন্তাচচার একটি স্বতন্ত্র ও উজ্জ্বল ধারা প্রচলিত হয়েছে গত দেড় দশকে। ১৯৮২ সালে ‘সাবলটার্ন স্টাডিজ’-এর প্রথম প্রকাশ, ১৯৮৩ সালে প্রথম সাবলটার্ন স্টাডিজ সম্মেলন ও গত বারাে বছরে আট খণ্ড ‘সাবলটার্ন স্টাডিজ সংকলন প্রকাশিত হওয়ার ঘটনা এই ইতিহাসচর্চার নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহপথটি চিহ্নিত করে। গত পনেরাে বছরে জ্ঞানেন্দ্র পাণ্ডে, ডেভিড হার্ডিম্যান, শাহিদ আমিন, ডেভিড আর্নল্ড, রণজিৎ গুহ প্রমুখ গবেষকদের স্বকীয় দৃষ্টিভঙ্গি ও বিশ্লেষণী ইতিহাসবােধ এই ধারাটিকে পুষ্ট করেছে। সাম্যবাদী দার্শনিক আন্তোনিও গ্রামশি-র দর্শনে যে-সাবলটার্ন। হিস্ট্রির সূত্রপাত, তারই নানা অব্যাখ্যাত ইঙ্গিত ও সূত্রের সময়ােপযােগী পরিমার্জন ও বিশ্লেষণের মধ্যে থেকে উঠে আসা নিম্নবর্গের ইতিহাসচর্চার এই ধারাটি, নিঃসন্দেহে বিবর্তনশীল সামাজিক বিন্যাস ও সামাজিক সম্পর্কের জটিল ও বহুস্তর বাস্তবতাটিকে সত্যের অনেক কাছাকাছি নিয়ে গিয়ে ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হয়েছে। মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে ‘সাবলটার্ন' শব্দটির (বাংলা প্রতিশব্দ নিম্নবর্গ) প্রথম প্রয়ােগ পাওয়া যায় গ্রামশি-র রচনায়। কখনও প্রলেতারিয়েত, কখনও বা আরও ব্যাপক সাধারণ অর্থেও শব্দটি ব্যবহার করেছেন তিনি। তাঁর চিন্তায় নিম্নবর্গের মানুষের। দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ইতিহাসের এক সমান্তরাল পাঠান্তর রচনার প্রয়ােজন প্রথম অনুভূত হলেও কোনও-কোনও ক্ষেত্রে তাঁর চিন্তা যেন অতিসরলীকরণে দুষ্ট, কোথাও-কোথাও অস্পষ্টও। ভারতের মতাে কৃষিপ্রধান দেশে, যেখানে বুর্জোয়া বিপ্লব ও ধনতন্ত্রের বিকাশ সুষমভাবে ঘটেনি, সেখানে অবশ্যই রয়ে গেছে শ্ৰেণীবৈষম্যের আরও জটিল স্তরভেদ। শ্রমিক ও কৃষকশ্রেণীর সমান্তরাল বিকাশের ক্ষেত্রে পুঁজিবাদী সমাজে শ্ৰেণীসম্পর্কের বিন্যাস কেমন হতে পারে, তা নিয়ে তুলনায় অনেক গভীর বিশ্লেষণ ধরা পড়েছে ভারতীয় সাবলটার্ন স্টাডিজের চিন্তা প্রকরণে। বিষয়টি জটিল, বুর্জোয়া দৃষ্টিভঙ্গির পঠন পাঠনে অভ্যস্ত আমাদের কাছে ঈষৎ দুর্বোধ্যও। কিন্তু আলােচ্য সংকলনে এই আপাতদুর্বোধ্যতার ওপারেও আছে সত্যের কিছু নিশ্চিত উদ্ভাস, ইতিহাসের কতিপয় নিহিত বাস্তবতা ও সর্বোপরি উদ্বর্তনশীল সামাজিক সম্পর্কের বিষয়ে নতুন আলােকপাত। নানা পর্যায় ও বিবর্তনের ভেতর দিয়ে নিম্নবর্গের যে সংগ্রাম তার যথার্থ পরিচয় এখানে তুলে ধরা হয়েছে একটি দীর্ঘ। ভূমিকাসহ নয়টি প্রবন্ধে : নিম্নবর্গের ইতিহাস ; গান্ধী যখন মহাত্মা ; একটি অসুরের কাহিনী ; দেবীর আবির্ভাব ; ইতিহাসের উত্তরাধিকার ; শরীর, সমাজ ও রাষ্ট্র : ঔপনিবেশিক ভারতে মহামারি ও জনসংস্কৃতি ; হিংসা, দেশান্তর ও ব্যক্তিগত কণ্ঠস্বর ; কথকতার নানা কথা ; এবং ভগ্নাংশের সমর্থনে : দাঙ্গা নিয়ে কী লেখা যায় ?
গৌতম ভদ্র-এর জন্ম ১৯৪৮-এ, কলকাতায়। আদি নিবাস খুলনা জেলার সাতক্ষীরা থানার উথলি গ্রামে। চেতলা বয়েজ স্কুল, প্রেসিডেন্সি কলেজ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ও জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথাগত শিক্ষা শেষ করার পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে সতেরো বছর শিক্ষকতা করেন। বর্তমানে কলকাতার সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেজ নামে গবেষণা প্রতিষ্ঠানে ইতিহাসের অধ্যাপক পদে নিযুক্ত আছেন। পেশার তাগিদে অল্পবিস্তর ইংরেজিতে লিখলেও বাংলা ভাষাতেই তিনি স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করেন। সাবঅলটার্ন স্টাডিজ-এর সম্পাদকমণ্ডলীর তিনি অন্যতম সদস্য ও ‘ঐতিহাসিক পত্রিকার যুগ্ম সম্পাদক।