'সুন্দরবনে সাত বৎসর' প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত রোমাঞ্চকর উপন্যাস। বিভূতিভূষণ এর মৃত্যুর দুই বছর পর, ১৯৫২ সালে উপন্যাসটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। কাহিনীর মূল চরিত্র নীলমণি রায় ওরফে নীলু। দাদার সাথে মেলা দেখতে গিয়ে ডাকাতদের খপ্পরে পড়ে সে। নীলুকে তারা নিয়ে যায় তাদের আবাসস্থল, সুন্দরবনের গহীন অরণ্যে, যেখানে প্রতি পদে পদে রয়েছে বিপদের ঘনঘটা।
কিশোর নীলু পড়ে যায় এক মহাবিপদে। এ বিপদ থেকে কীভাবে তার উদ্ধার মিলবে সে তা জানে না। বাধ্য হয়ে সুন্দরবনের বিপদসংকুল পরিবেশের সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে আরম্ভ করে সে। এভাবেই পার হতে থাকে দিকদিন পেরিয়ে আসে মাস। মাসের পর বছর। সময়ের এই পরিক্রমায় জুটে যায় কিছু বন্ধু। এগিয়ে চলতে থাকে উপন্যাসের কাহিনি। পুরানো দিনে গঙ্গাসাগর-তীর্থ কেমন ছিল, তার একটা মোটামুটি চিত্র উপন্যাসের সূচনা-অংশ থেকে পাওয়া যায়। বাঘ, কুমীর, বুনো মহিষ, অজগর অধ্যুষিত অবিভক্ত বাংলার ভয়ঙ্কর সুন্দরবনের পরিচিতিও
মেলে।
রোমাঞ্চকর উপন্যাসটি এক সময় বেদনাবিধুর ঘটনাপটে মোড় নেয়। ঘটনাচক্রে নীলু গিয়ে পৌঁছে কাছিমখালি চরে। সেখানে তার পরিচয় ঘটে এক বৃদ্ধের সাথে। বদলে যায় নীলুর জীবনের গতিপথের প্রকৃতি।
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বেশ কিছু কালজয়ী উপন্যাস রচনার মাধ্যমে জয় করে নিয়েছেন বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের হৃদয়। শুধু উপন্যাসই নয়, এর পাশাপাশি তিনি রচনা করেছেন বিভিন্ন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, দিনলিপি ইত্যাদি। প্রখ্যাত এই সাহিত্যিক ১৮৯৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন, তবে তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল যশোর জেলায়। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র হিসেবে তিনি শিক্ষাজীবন অতিবাহিত করেন, যার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর প্রথম বিভাগে এনট্রান্স ও আইএ পাশ করার মাধ্যমে। এমনকি তিনি কলকাতার রিপন কলেজ থেকে ডিস্টিংশনসহ বিএ পাশ করেন। সাহিত্য রচনার পাশাপশি তিনি শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন অতিবাহিত করেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমূহ এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো 'পথের পাঁচালী', যা দেশ ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হওয়ার মাধ্যমে। এই উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ করে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় অর্জন করেছেন অশেষ সম্মাননা। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই এর মধ্যে আরো উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো 'আরণ্যক', 'অপরাজিত', 'ইছামতি', 'আদর্শ হিন্দু হোটেল', 'দেবযান' ইত্যাদি উপন্যাস, এবং 'মৌরীফুল', 'কিন্নর দল', 'মেঘমল্লার' ইত্যাদি গল্পসংকলন। ১০ খণ্ডে সমাপ্ত ‘বিভূতি রচনাবলী’ হলো বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমগ্র, যেখানে প্রায় সাড়ে ছ’হাজার পৃষ্ঠায় স্থান পেয়েছে তার যাবতীয় রচনাবলী। খ্যাতিমান এই সাহিত্যিক ১৯৫০ সালের ১ নভেম্বর বিহারের ঘাটশিলায় মৃত্যুবরণ করেন। সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি মরণোত্তর 'রবীন্দ্র পুরস্কারে' ভূষিত হন।