যে কোনো ধরনের সাহিত্যেরই একটা অঙ্গীকার থাকে। গল্প, কবিতা, মহাকাব্য ও উপন্যাসে যে অঙ্গীকার থাকে, সেটি থাকে প্রধানত পরোক্ষভাবে। কিন্তু প্রবন্ধসাহিত্যে থাকে প্রত্যক্ষভাবে। সক্রেটিস, প্লেটো, রুশো, মার্কস, ফুকোর মতো মনীষীদের প্রবন্ধসাহিত্যের অঙ্গীকার পরিষ্কার বোঝা যায়।
লেখক ও চিন্তক রইসউদ্দিন আরিফের লেখা এই বইটি একমাত্রিক নয়, বহুমাত্রিক। এতে ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, রাজনীতি ও দর্শন আছে। ধর্ম ও ধর্মের পর্যালোচনা আছে। আরো আছে নানাবিধ বিতর্কিত ও স্পর্শকাতর বিষয়। এক মলাটের মধ্যে একসাথে এতগুলো জটিল বিষয়ে লেখার অঙ্গীকার বুঝতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে ভুলবোঝাবুঝি, সংশয় ও বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ার সম্ভাবনা থাকে।
তবে, পাঠক মহলে সাড়া জাগানোর মতো এবং প্রচলিত সমাজকে ঝাঁকুনি দেওয়ার মতো, আরিফের এই বইটি মনোযোগ সহকারে আদ্যপান্ত পাঠ করলে পরিষ্কার বোঝা যায়, এই লেখার অঙ্গীকার একটাই, আর সেটি হলো— মানুষ, জীব, অনুজীব ও প্রকৃতির মুক্তি। এই মুক্তি শুধু অর্থনৈতিক ও বৈষয়িক মুক্তি নয়, বরং সকলপ্রকারের সংস্কার থেকে মুক্ত হয়ে, নৈর্ব্যক্তিক বিশ্বদৃষ্টিকোণ অর্জনের মাধ্যমে মানুষের চিন্তা, চেতনা, মনন ও দার্শনিকতারও মুক্তি।
লেখকের মতে মানুষ সংস্কারমুক্ত হয়ে নৈর্ব্যক্তিক বিশ্বদৃষ্টিকোণ অর্জন করতে পারলে, জগতের সকলকিছু একাকার হয়ে যায়। তখন ‘আস্তিক-নাস্তিক বিতর্ক থাকে না, ধর্ম নিয়ে মানুষে মানুষে হানাহানি থাকে না, ধর্মান্ধতা থাকে না এবং পুঁজিবাদ, বৈষম্য, জাতীয়তাবাদ, মারণাস্ত্র, যুদ্ধ কিছুই থাকে না। থাকে শুধু প্রজ্ঞা, প্রেম ও শান্তি’।
বাংলাদেশের রাজনীতি-অর্থনীতি, সমাজ-সংস্কৃতি নিয়ে লেখালেখি ও গবেষণার অঙ্গণে ব্যতিক্রমী লেখক। রইসউদ্দিন আরিফের জন্ম ১৯৪১ সালে, ময়মনসিংহ জেলার ফুলবাড়িয়ার অজপাড়ায় এক ক্ষয়িষ্ণু সামন্ত পরিবারে। পড়ালেখা গ্রামের স্কুল, আনন্দমােহন। কলেজ, ময়মনসিংহ টিচার্স ট্রেনিং কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ষাটের দশকের প্রথমদিকে আনন্দমােহন কলেজে ছাত্রআন্দোলনের মাধ্যমে বাম রাজনীতির শুরু। সত্তরে। বিপ্লবী সিরাজ সিকদারের পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলনের সাথে যােগাযােগ। একাত্তরে সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বাধীন পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টিতে যােগদান। বাহাত্তরের শেষেরদিকে রক্ষীবাহিনীর হুমকির মুখে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত স্ত্রী ও কোলের শিশুপুত্রসহ সার্বক্ষণিক বিপ্লবী ক্যাডার হিসেবে আত্মগােপন। কষ্টকর ও বিপজ্জনক আন্ডারগ্রাউন্ড জীবনযাপন কালে সহধর্মিনী কমরেড রাশিদা বেগম ওরফে রানুর অকালমৃত্যু। কমরেড সিরাজ সিকদার নিহত হওয়ার পর, ১৯৭৬ সালে সর্বহারা পার্টির অস্থায়ী পরিচালনা কমিটির (অপক) সম্পাদক নির্বাচিত হন। সাতাত্তর-আটাত্তরে কারাবরণ জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর প্রচারবিমুখ। এই লেখক সক্রিয় রাজনীতি ছেড়ে দীর্ঘদিন যাবৎ ইতিহাস, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ, সংস্কৃতির বিষয় নিয়ে লেখালেখি ও গবেষণার কাজে সম্পৃক্ত আছেন। তার প্রকাশিত অনেক গ্রন্থের মধ্যে আন্ডারগ্রাউন্ড-জীবন সমগ্র - দেশে ও বিদেশে বহুল সমাদৃত।