গৃহসজ্জার অর্থ যদি হত রুচিশীল শৈলীতে ঘর সাজানো, তাহলে তো কোনও অন্দরমহল বিশেষজ্ঞকে ডাকার প্রশ্নই উঠতো না । আপনি নিজে অনায়াসে ঘর সাজানোর ব্যবস্থা করতে পারতেন । কিন্তু গৃহসজ্জার গোপন মন্ত্রটি হল রুচিশীলতার সঙ্গে ব্যবহারিক সুবিধের সমন্বয় । অর্থাৎ আপনার বাড়িটি শুধু মাথা গোঁজার আশ্রয় নয়, উপভোগ করার স্থানও বটে ! শুধু মানুষ কেন পশুপাখিরাও তাদের বাসা বা থাকার জায়গাটিকে গুছিয়ে রাখতে ভালবাসে । আমরা অবশ্য আমাদের বাড়িতে অনেক বেশি সময় কাটাই এবং তার সুব্যবস্থার প্রতি অনেক বেশি নজর দিয়ে থাকি । যেহেতু জীবনের অনেকটা সময়ই আমাদের বাসস্থানে কেটে যায়, তাই কোনও না কোনও সময় সেটিকে সাজিয়ে-গুছিয়ে নেওয়ার প্রবণতাও বাড়ে । যেমন ভাবেই আপনি ঘর যদি কোনও বিশেষজ্ঞের হাতে দেন তাহলেও গৃহসজ্জা সম্বন্ধে খানিকটা ধারণা থাকা বাঞ্ছনীয়, না হলে কোনটা সম্ভব, কোনটা আপনার রুচির সঙ্গে মেলে সেটা বুঝবেন কী করে ? অবশ্য ঘর সাজানোর দায়িত্বটা নিজে নিলেই সবথেকে ভাল হয় ৷ সেক্ষেত্রে নকশা, কাঠ, পর্দার কাপড় ইত্যাদি বিষয়ে ওয়াকিবহাল থাকতেই হবে। হয়তো মামুলি একটি টেবিল-ল্যাম্প কেনার কথা ভাবছেন, কিন্তু সেটিও ঠিক কীরকম হলে মানানসই হবে জানা থাকলে সুবিধেটা আপনারই । এই বইটিতে যে সাদাসিধে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তা গৃহসজ্জার মায়াজালটিকে অনাবৃত করতে সাহায্য করে । অথচ অন্দরমহল সুসজ্জিত করার জাদু এর জন্য কোনওমতেই নষ্ট হয় না, উপরন্তু আপনার হাতে নিয়ে আসে গৃহসজ্জার জাদুকাঠিটি । কেমন করে একটি দেওয়াল ভাঙবেন, কী করেই বা তৈরি করবেন একটি রান্নাঘরের আসবাব সেসব তথ্য অবশ্য এখানে পাবেন না । তবে চোখ বন্ধ করলে দেখতে পাবেন কী ভাবে একটি ঘর সাজানো যায়, তার রং, আলো এবং পরিসর । যে সব ছবি ব্যবহার করা হয়েছে তার অনেকগুলিই এখনকার গৃহসজ্জার ধারার প্রতিফলন । দেখতে পাবেন ইট, কাঠ বা টালির উপযোগিতা, সবুজ, লাল বা খয়েরি রং-এর ব্যবহার । কিন্তু এখন প্রচলিত হলেও এই গৃহসজ্জার ধারা অত্যাধুনিক নয়, বরং তা প্রাচীন এবং আধুনিকতার সুন্দর সমন্বয় মাত্র । আধুনিক অন্দরমহল বিশেষজ্ঞরা যে নতুনত্ব এবং আধুনিকতার সঙ্গে পুরনো জিনিসের উপস্থিতি মানিয়ে নিয়েও গৃহবাসীর নিজস্ব বৈশিষ্ট্যগুলি রাখতে পেরেছেন, এগুলি তারই দৃষ্টান্ত । আমার উদ্দেশ্য নয় যে বাড়ির ছক এঁকে তার নিখুঁত সজ্জাব্যবস্থা দেওয়া, আবার শুধুমাত্র গৃহসজ্জার এলাহি ব্যবস্থা দিয়ে আপনাদের তাক লাগিয়ে দিতেও চাই না । তার পরিবর্তে আপনারা নিজেরাই যদি নিজেদের বাড়ি বা ঘর সাজাবার সঠিক পন্থাটি খুঁজে পান, গৃহসজ্জার খুঁটিনাটিগুলি বুঝতে পারেন তাহলেই এই প্রচেষ্টা সার্থক হয়েছে বলে মনে করব । আশাকরি প্রতি পাঠকই এর থেকে ..এমন কিছু শিখতে পারবেন যা তাঁর পক্ষে নিজের সুবিধে অনুযায়ী প্রয়োগ করা সম্ভব হবে । এবং এর দরুণ গৃহসজ্জা সম্পর্কে তাঁদের ভ্রান্ত ধারণাগুলিও সহজেই মুছে যাবে । আমি আরও মনে করি যে গৃহিণী এবং গৃহসজ্জা বা ইন্টিরিয়ার ডিজাইন-এর ছাত্রছাত্রীদের পক্ষে এই বইটি বিশেষ ভাবে উপযোগী । এই ভিত্তির ওপরে আরও ব্যাপক শিক্ষা এবং অভিজ্ঞতা তাঁদের পেশাদার ডিজাইনার হতে সাহায্য করবে । গৃহসজ্জার উপদেষ্টা হিসেবে আজ যে আমি এই বিষয়টির সারটুকু বইয়ের মাধ্যমে পাঠকদের কাছে উপস্থিত করতে পারছি, তা সম্ভব হয়েছে অনেকের উৎসাহ এবং অনুপ্রেরণার জন্য । এঁদের মধ্যে সর্বাগ্রে আসে আমার মা তরলিকা সেন-এর নাম। আমার জীবনে যেটুকু শিল্প আয়ত্ত করতে পেরেছি, তার সবটুকুই তাঁর কাছে শেখা । আজ যে আমি সাহস করে বাংলা ভাষায় অন্দরমহল বা গৃহসজ্জার বই প্রকাশ করতে পারছি তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ ‘দেশ' পত্রিকার সম্পাদক সাগরময় ঘোষ-এর কাছে । সাগরদাই প্রথম তাঁর পত্রিকায় আমাকে দিয়ে এ বিষয়ে লিখিয়েছিলেন । বইটি যে শেষ পর্যন্ত প্রকাশিত হল, তার সম্পূর্ণ দায়িত্ব আনন্দ পাবলিশার্স এবং বাদল বসু-র । এঁদের সহযোগিতা ছাড়া প্রকাশনা এবং মূদ্রণ কোনওটাই সম্ভব হত না । বইটিকে বাংলায় রূপান্তর করেছেন আমার সহকর্মী এবং স্নেহের পাত্রী বিশাখা ঘোষ । পরিকল্পনার সময় থেকেই বিশাখার উপস্থিতি আমাকে সাহায্য করেছে । এই বইয়ের ছবি তুলেছেন আলোকচিত্রী বিবেক দাস ও সেলিম পাল । তাছাড়া 'সানন্দা' পত্রিকার সমস্ত সহকর্মীদেরই জানাই ধন্যবাদ তাঁদের অবিরত উৎসাহের জন্য এবং বিশেষ ভাবে সম্পাদক অপর্ণা সেন-কে । শিল্পী জয়ন্ত ঘোষ বইটির শিল্পপরিকল্পনার ভার নিয়ে আমাকে দায়মুক্ত করেছেন। বিশেষ ভাবে সাহায্য পেয়েছি আর্কিটেক্ট অশোক নায়ার-এর কাছে। এই বইয়ের অলঙ্করণ করেছেন আমার বন্ধু এবং সহকর্মী সমীর সেন । প্রচ্ছদ অলঙ্করণ কৃষ্ণেন্দু চাকীর। যাঁদের বাড়ির ছবি ব্যবহার করা হয়েছে তাঁদেরও জানাচ্ছি ধন্যবাদ । এঁদের সকলের কাছেই আমি নানা ভাবে ঋণী ।