"স্ত্রীলিঙ্গ নির্মাণ” বইয়ের ফ্ল্যাপের লেখা: নারী হয়ে কেউ জন্মায় না, কেউ-কেউ নারী হয়ে ওঠে বলেছিলেন সিমােন দ্য বােভােয়া। অথাৎ জৈবিকভাবে এক-একজন স্ত্রী-অঙ্গ নিয়ে জন্মায়—এইটুকুই প্রাকৃতিক সত্য। জন্মলগ্নে সে জানে না, সে নারী না পুরুষ। তারপর পদে-পদে তাকে টিপ পরিয়ে, ঝুটি বেঁধে, পুতুল খেলিয়ে, রান্নাবাটি ধরিয়ে দিয়ে, বাইরে ঘােরা বন্ধ করে, অবৈজ্ঞানিক সংস্কারে বন্দী করে, সর-হলুদ মাখিয়ে সামাজিকভাবে তাকে ক্রমশ মেয়েলি করে তােলা হয়। তার সামনে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় কোড অব কন্ডাক্টের নানান বিধিনিষেধ। লিঙ্গের কৃত্রিম ধারণা ও বিভাজন আরােপ করে তারই সমাজ। আচরণে, আলাপচারিতে, সাহিত্যে, দর্শনে, গানে, কবিতায়, ঠাট্টায়, পােশাক-নির্বাচনে—এমন প্রতিটি ক্ষেত্রে এই লিঙ্গ-নির্মাণ চলতেই থাকে। স্ত্রীলিঙ্গ-নির্মাণের অনিঃশেষ এই-যে প্রক্রিয়া, এরই চেহারাটা এই বইতে চিরে-চিরে দেখিয়েছেন কবি ও সমাজতত্ত্বের অধ্যাপিকা মল্লিকা সেনগুপ্ত। কীভাবে শিশুকন্যা ধীরে-ধীরে সমাজের মনােমত নারী হয়ে ওঠে, যা-কিছু পৌরুষের প্রতীক বলে ভাবে সমাজ তারই বিপরীত লক্ষণগুলি দিয়ে কী কৌশলে চলে নারীত্ব-নির্মাণ, কীভাবে এই লিঙ্গ-বিভাজন নারীর জন্য তৈরি করে অসাম্য ও বঞ্চনার আপাত-অদৃশ্য চোরাবালি, কীভাবে নারীর বিদ্রোহকে বারবার চাপা দেওয়া হয়েছে এবং আজও হয়—এ বইতে তারই বিস্তৃত, ব্যাপক, বিশ্লেষণী অনুসন্ধান। সাহিত্য, ইতিহাস, পুরাণ, দর্শন, সমূহ শাস্ত্র মন্থন করে, কবিতা ও সমাজতত্ত্বের সঙ্গে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার মিশ্রণ। ঘটিয়ে এ-এক নতুন মানবীবিদ্যা, যা প্রশ্নের পর প্রশ্নে জর্জরিত করে তুলবে একচক্ষু সমাজের প্রচলিত ধারণাগুলিকে। তুলবে নতুন বিতর্কের ঝড়।
মল্লিকা সেনগুপ্তর জন্ম ২৭ মার্চের ১৯৬০ সালে ভারতের নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগর শহরে। তাঁর কবি জীবন শুরু ১৯৮১ সালে এবং সেই থেকে তিনি ১১টি কবিতার বই, দুটি উপন্যাস এবং বিভিন্ন প্রবন্ধ লিখেছেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিদ্যা কেন্দ্রে অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। ৯০ এর দশকে তিনি অপর্ণা সেন সম্পাদিত 'সানন্দা' পত্রিকার কবিতা বিভাগের সম্পাদনা করতেন। স্বামী সুবোধ সরকারের সাথে তিনি 'ভাষানগর' নামক একটি সাংস্কৃতিক পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। মল্লিকার কবিতা আপষহীন রাজনৈতিক ও নারীবাদী হিসেবে পরিচিত। তাঁর লেখনির গুণে তিনি আন্তর্জাতিক স্তরেও প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। তাঁর লেখা ইতোমধ্যেই বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার তাকে সুকান্ত পুরস্কার, বাংলা একাদেমি এ্যাওয়ার্ড এবং ফেলোশিপ ফর লিটারেচার দিয়ে সম্মানিত করেছেন। ইতিহাসের ব্রাত্য নারী চরিত্ররা প্রায়ই তাঁর লেখায় পুনর্জীবিত হয়েছেন। সমসাময়িক কবি সংযুক্তা দাসগুপ্তের ভাষায় "তার কবিতায় নারীস্বত্বা কেবলমাত্র অন্তর্ভূতি সচেতনতা হিসেবেই থেকে যায় না, সেটা প্রস্ফুটিত হয় সমস্ত প্রান্তিক নারীর নিপীড়নের বিরুদ্ধে এক স্বতস্ফুর্ত প্রতিবাদ।"