এই সেদিনও ব্যক্তির আত্মপ্রকাশের দর্পণ ছিলো চিঠি। চিঠি ছিলো মানব সভ্যতার মঙ্গলদূত কিংবা চিন্তাচর্চার জিয়নকাঠি। চিঠি ছিলো শিল্পসত্তার পরিচয়ে উদ্ভাসিত, যেটির ভাষা ছিলো ভাবরসে সিক্ত; থাকতো তাতে হৃদয়াবেগের প্রগাঢ় প্রকাশ। আর আজ প্রযুক্তিস্রোতে অবিরাম স্ক্রলিংয়ের ব্যতিব্যস্তে পড়াশোনা হয়ে গিয়েছে দেখাশোনা, লেখালেখি হয়ে গিয়েছে দেখাদেখি, ভাবনা হয়ে উঠেছে দূরভাবনা। চিঠি ছিলো প্রিয়তমা, বাবা-মা, বন্ধুদের তথ্যধারক বার্তাবাহক। প্রেরকের প্রেমরসের চিঠি প্রাপকের আবেগ-অনুভূতিকে ছুঁয়ে যেত। কল্পনার আধিপত্য, মননের প্রগাঢ়তা ও সৃষ্টিপ্রাচুর্যের শিল্পিত বিচিত্র ক্ষণ থাকতো চিঠিতে। কবে আসবে ডাকপিয়ন হাঁক ছেড়ে সেই উত্তেজনায় ও অপেক্ষায় প্রহর কাটতো না।
খাম খুলে চিঠি বের করার আগ পর্যন্ত এক অজানা চাপা ভাবাবেগ, উৎকণ্ঠা, অনিশ্চয়তা কাজ করতো; সে আজ ব্যাখ্যাতীত। চিঠি খোলার সেই অজানা চাপা অনুভূতির পুনরাবৃত্তি আর হবে না। চিঠিপত্র, খাম, ডাক টিকিট সংগ্রহ করা ছিলো নান্দনিক শখ। মানুষের আবেগ-অনুভূতি, চিন্তা-চেতনা ও সুখ-দুঃখ থাকতো চিঠির পাতা জুড়ে, এ ভাবনা আজ অতীত। মানুষ ভুলতে বসেছে চিঠির কথা। মরিচা ধরছে লালরঙা ডাকবাক্সে। চিঠির কালো অক্ষর পড়ে চোখ ভিজেছে কত প্রেয়সীর! হলুদাভ খামের ভেতর নীলাভ, সবুজাভ অথবা গোলাপি রঙের কাগজে মন ভোলানো প্রেমালাপ থাকতো। আজ নেই সেই পত্রমিতালি, নেই পত্রমিতা। আজ ফেসবুক, মেসেঞ্জার, ইমো, ইনস্টাগ্রাম, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপ, ই-মেইল ইত্যাদি অন্তর্জালের দুনিয়ায় কলমিবন্ধু শব্দটিই নেই। ডাকপিয়নের ডাক আর শোনা যায় না পথে পথে।
প্রযুক্তিআশ্রিত হৃদয়ে আগের সেই গাঢ় অনুভূতি নেই, প্রেমপত্র বিলুপ্ত। যা দুই একটি চিঠি ডাক অফিসে খামভর্তি পড়ে থাকে তার ষোলো আনাই দাপ্তরিক।
চিঠি-পত্র, পত্রসাহিত্য সবই আজ পরাভবের মুখে। অথচ এই প্রযুক্তিযুগেও সৌমেন দেবনাথ অতীত স্মৃতি রোমন্থন করে চিঠি লিখেছেন তাঁর কাছের মানুষ অবন্তীকে। তাঁর আঙুলের মিহি সেলাইয়ে বয়ানের যে বুনন তা স্বকীয়তায় ভাস্বর। বুদ্ধিবৃত্তি ও অনুভবকে কাজে লাগিয়ে চিঠিজনিত স্মৃতিকে সবার সামনে এনেছেন তিনি ❝কালো গোঁসাইয়ের চিঠি❞ পত্রসাহিত্যের মাধ্যমে। পত্রসাহিত্যটি পাঠান্তে হৃদয় ভারাকুল হয়ে চলে গিয়েছিলো আশি-নব্বইয়ের দশকে। পাঠকও পত্রসাহিত্যটি পড়ে বিহ্বলিত হবেন বলে আশা রাখি।